" হালুয়া খেয়েছে কালুয়া "
দুপুরে আমরা হাজিবাগানে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছি । যতসব আজগুবি ভূতুরে গল্প আর হাসিঠাট্টা চলছে ।হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বাগানের উত্তর-পশ্চিম কোণে পড়ে থাকা শিশুগাছের গুঁড়িটাতে চাম্পু বসে আছে ।
কিন্তু চাম্পুর পাশে ওই ছেলেটা কে !
আরে, এ তো বিহারী গলির বিহারী কালুয়া !
কিন্তু চাম্পু কালুয়ার সাথে কি করছে ! ফিস্ ফিস্ করে কিসের গল্প করছে ওরা ! কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না ।
কালুয়ার সাথে চাম্পুর এত গায়ে পড়া ভাব দেখে আমি অবাক হলাম । কালুয়াকে তো চাম্পু একদমই দেখতে পারত না ।
তবে এখন কি হল !
একটু কাছে গিয়ে দেখলাম, বিহারী কালুয়াকে চালতার আঁচার খাওয়াচ্ছে চাম্পু !
কিন্তু কেন ?
কি ব্যাপার !
এর পিছনে কি কোনো রহস্য আছে !
নিশ্চয় চাম্পুর কোনোরকম চালাকি রয়েছে । কিন্তু কিরকম চালাকি, তা ঠাহর করতে পারলাম না ।
আমি একটু রহস্য করে বললাম, কি রে চাম্পু ! কি করছিস ভাই, কালুয়াকে কি বোঝাচ্ছিস ভাই !
আমাকে দেখে চাম্পু মুখটা কেমনধারা একটা করল । তবে বুঝতে অসুবিধে হল না যে আমাকে দেখে ওর মোটেও ভালো লাগেনি ।
কিন্তু চাম্পু আর কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও সচরাচর আমার সাথে খুব একটা খারাপ ব্যবহার করে না । কিন্তু ও যেরকম মুখাভঙ্গি করল তাতে বুঝলাম
আমার উপস্থিতি ওকে বিরক্ত করেছে এবং বেশিক্ষণ এখানে থাকলে ও আরও বিরক্ত হতে পারে ।
অতএব অতকিছু না ভেবে বাগানের এদিকটাতে চলে এলাম এবং আমাদের আড্ডাতে মেতে গেলাম ।
আগামীকাল ছোটপূজো । প্রতিবছর আমাদের পশ্চিমপাড়ার পগারের শিবপুকুরে ছোটপূজার আয়োজন করা হয় ।
পুকুরের চারিদিকে লাইট দিয়ে সাজানো হয় দেখতেও বেশ ভালো লাগে, আর পুকুরের ঘাট জুড়ে ছোট্ট একটা মেলা বসে ।
হাজার হাজার পূজার্থীর ও পূণ্যার্থীর সমাগম ঘটে এই ছোট্ট পুকুরখানা জুড়ে । স্থানীয় লোকেরাও ভিড় জমায় ।
আমরাও দল বেঁধে যায় মেলা দেখতে । চাম্পুই আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় । আগের বারে এবং তারও আগের বারে তাই করেছিল ।
ঝুড়িতে নানান রকমের ফল মাকড় নিয়ে উপস্থিত হয় পূজার্থীরা, আর আমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি সেই ফল ভর্তি ঝুড়িগুলোর দিকে ।
বিকেল বেলা পূজা টুজো করে পরের দিন ভোরবেলায় আবার পূজা করতে আসে তারা । কেউ কেউ আবার তাসা পার্টী বা
বক্স বাজিয়ে পূজো করতে আসে । পুরো বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা খুব মজা করি সেদিন ।
আবার ভোরবেলায় বাজনা শুনে ঘুম ভেঙে গেলে এক ছুটে পুকুরঘাটে চলে আসি । পূজো শেষ হলে ওরা প্রসাদ হিসেবে ঠেকুয়া দেয়, ফল দেয় ।
আমার ঠেকুয়া খেতে খুব ভালো লাগে কিন্তু চাম্পুর আবার ঠেকুয়া খেতে ভালো লাগেনা । চাম্পুর হালুয়া খেতে ভালো লাগে, কিন্তু হালুয়া তো বিলি করে
না, ওগুলো তো বাড়ীতে খাওয়ার জন্য বানায় ।
চাম্পু আবার হাত সাফাই করতে উস্তাদ, কোথায় শিখেছে কে জানে ।
গতবারের পূজোর সময় ঝুড়িতে পাকা কলার কান্দি থেকে কত যে কলা গায়েব করেছে তার নাই ঠিক । আমাকেও দিয়েছে অনেকবার, প্রথমে খেতে
চাইনি চুরি করা বলে । কিন্তু পরে চাম্পু যখন বলল যে এগুলো নাকি ভগবানের প্রসাদ । অনেকবার চেয়েও যখন দিল না তখন
বাধ্য হয়েই তাকে চুরি করতে হয়েছে । ভগবানের প্রসাদ খেলে নাকি কোনো পাপ হয় না ।
তখন আমিও গব গব করে গিলে ফেললাম ।
এবারেও ভগবানের প্রসাদ পাবো তো । কিন্তু চাম্পু যে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না ।
কথাটা চাম্পুকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার ।
কিন্তু কোথায় সে ? তার টিকি টুকুরও দেখা মেলা ভার ।
সব সময় সে ব্যস্ত ! কিন্তু কিসের যে এত ব্যস্ততা বুঝতে পারিনা । যাগ্ গে সন্ধ্যে বেলায় মনে করিয়ে দেবো ।
বিকেল গড়িয়ে আসছে দেখে আমরা স্কুলমাঠে ব্যাটবল খেলতে চলে গেলাম ।
অনেকক্ষণ হল খেলা শুরু হয়ে গেছে । হঠাৎ কুতুব ওভার বাউন্ডারি লাগিয়ে দিল ।
আমার মাথার ওপর দিয়ে বলটা বেরিয়ে গেল, ধরতে পারলাম না । উত্তরদিকের কচুরীপানার ডোবাতে বলটা
পড়েছে । একহাঁটু জলে নেমে বলটা তুলে নিলাম । বলটা নিয়ে মাঠের দিকে ফিরতেই দেখলাম চাম্পু । চাম্পু আর সেই বিহারী
কালুয়া ডোবার ধারে পরিত্যক্ত ভাঙা ইঁটের টিলায় বসে আছে । ডোবাটার দিকে মুখ করে কিছু একটা খাচ্ছিল, আমাকে দেখে লুকিয়ে নিল ।
এতক্ষণ ধরে খেলছি কিন্তু একবারও ওদের লক্ষ্য করিনি । চাম্পু আমাকে দেখেও এমনভাবে না দেখার ভান করল যেন আমাকে চেনেই না ।
চাম্পুর এমন ব্যবহারে আমার মোটেও রাগ হল না বরং আমি একটু অবাক হলাম ।
খেলা শেষে মাঠে বসে গল্প করছিলাম । হঠাৎ কুতুব বড়মানুষী গলায় বলল,
কি ব্যাপার রে ! কালুয়ার সাথে চাম্পুর দোস্তি কবে থেকে হল ।
আমি কিছুটা বিস্মৃত হয়েই বললাম, কি জানি !
বললাম, " কাল তো কালুয়াদের পূজো । ওদের গলিতে তাসা পার্টীর কত লোক এসেছে, গান বাজনা হচ্ছে । সেসব ছেড়ে কালুয়াটা চাম্পুর সাথে কি করছে বলত ।! "
সবাই চুপ করে রইল । আমরা কেউই এর রহস্য ভেদ করতে পারলাম না । আমরা যে যার বাড়ীতে ফিরে গেলাম ।
সন্ধ্যে বেলায় দোকান করতে বাইরে এসে আবার চাম্পুকে দেখলাম ঐ কালুয়ার সাথে । হাজীবাগানের পাশে অন্ধকার ভুতুরে গলিটাতে কি যেন একটা করছে ।
কালুয়ার হাতে একটা জলন্ত ধূপকাঠি ।
এই গলি দিয়ে যেতে আমার খুব ভয় করে । কিন্তু কালুয়া তো সন্ধ্যে হলে ঘর থেকেই বেড়োয় না । আর যদিও কোনো কারণে
বেড়োয় তবে একা একা কখনও এই গলি পেরোয় না । কারো সাথ না পেলে এই রাস্তা পার হয় না ।
আস্তে আস্তে ওদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক এমন সময় ফটাস্ করে কি একটা শব্দ হতেই পুরো আঁতকে উঠলাম । বুকটা ধড়াক্ ধড়াক্ করতে শুরু করে দিল ।
ধানী পটকার শব্দ । খুব জোরে না হলেও হঠাৎ করে কানে ঢুকল কিনা তাই চমকে উঠলাম !
বাপ্ রে ! জান বাঁচা, লাখো পায়ে ।
আমাকে হাঁসফাঁস করতে দেখে কালুয়া ফ্যাঁকফ্যাঁক করে হেসে ফেলল । ইচ্ছে করল কালুয়া কানের দুআঙুল নিচে একটা কষিয়ে দিই ।
না থাক্ গে, কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলা পাকানোর !
চাম্পু কালুয়াকে পটকা ফাটানো শেখাচ্ছে তাও আবার হাতের মধ্যে রেখে ।
বড়ো আশ্চয্য ব্যাপার !
কালুয়ার হাতের মধ্যে একটা ধানী পটকা আর কালুয়ার হাতের কনুইটা চাম্পু ধরেছে । কালুয়া দিব্যি হাতে পটকা ফাটালো ।
অবশ্য চাম্পু ওর হাতটা ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু ফাটালো তো কালুয়ায় নাকি ! আমি থ হয়ে গেলাম । আমারও সাহসে কুলোয় না হাতে রেখে পটকা ফাটানোর ।
কিন্তু চাম্পুর কাছে এসব যেন বাঁ হাতের খেল । কি করে পারে কে জানে !
চাম্পুকে দুবার সাড়া দিলাম কিন্তু সে আমাকে তোয়াক্কাই করল না । ভাবলাম কালকের প্রসাদের কথাটা মনে করিয়ে দিই কিন্তু চাম্পু তো আমার কথা শুনতেই চাই না ।
আমার খুব রাগ হল তাই ওখানে আর দাঁড়ালাম না । দোকান করতে চলে গেলাম । দেরি করলে আবার ওদিকে মায়ের বকা খেতে হবে ।
কালুয়ার সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার । কালুয়াদের আদি বাড়ি বিহারের ছাপড়ায় । এক অজানা কারনে কালুয়ার দাদা এবং দাদি বর্ধমানে চলে আসে আর
তারপর এখানেই থেকে যায় । কালুয়ার দাদাজীর বয়স সত্তর পচাত্তর হবে । এই বয়সেও বুড়োটা রাজমিস্ত্রীর কাজ করে আর তাছাড়া কাজ না করলে খাবে কি ।
ওরা খুব গরীব । একটা ছোট্ট দুকামরার চালা ঘরে থাকে । একটু খানি উঠোন আর তার এককোণে একটা মাটির চুলো, চুলোর পাশে দুখানা তাক আর তাকে কৌটোর মধ্যে তেল, নুন, জিরা, ধনে ইত্যাদি ।
বুড়ি ভালো চোখে দেখে না, হয়ত ছানী পড়ার কারনে । বুড়ি আবার কানেও খাটো । সারাদিন ঘরেই থাকে, খুব একটা বাইরে বেড়োয় না ।
আহারে ! আমার খুব মায়া হয় ওদের দেখে ।
আমি মাঝেমধ্যে কালুয়াদের ঘর যায় । বুড়ো বুড়ি আমার সাথে গল্প করে, হিন্দীতে কথা বলে । আমিও ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি, খুব ভালো লাগে ওদের সাথে কথা বলতে ।
কাল কালুয়াদের পূজো, ওর দাদি অনেক কিছু বানায় এদিন । সুজির হালুয়া, ছোলার ডালের হালুয়া আর ঠেকুয়া তো আছেই তারওপর কত রকমের ফল থাকে ।
আগের বছর আমাকে ঠেকুয়া খাইয়েছিল । হেব্বি লেগেছিল খেতে । আবার নারকেলের নাড়ু খাইয়েছিল । খুব ভালো কালুয়ার দাদি ।
এইবারও নিশ্চয় করবে, ঠিক করলাম কাল সন্ধ্যেবেলায় অবশ্যই যাবো । তাহলে ঠেকুয়া পাবো ।
কিন্তু দাদুর শরীরটা কিছু দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না । গত পরশুদিন যখন বিহারী গলিতে গিয়েছিলাম, তখন কালুয়ার দাদি বলেছিল । দাদুর নাকি পেটটা ঢিস্ হয়ে থাকে ।
পেটটা ঠিক মতো ক্লিলায় হচ্ছে না । প্রতিদিন সকাল সকাল দাদু ধানকলে গিয়ে প্রাতঃকর্মটা সেরে ফেলেন কিন্তু ইদানিং কয়েকদিন যাবৎ দাদুর প্রাতঃকর্মে হঠাৎ হঠাৎ বিশ্রাম লেগে যাচ্ছে ।
চারদিন ধরে পেটপুজো করার পর সবে মাত্র একদিন কুটুম পাড় করে আসছেন । তাই পেটের অবস্থা সংকটজনক ।
ডাক্তারে তরল খাদ্য খেতে বলেছে । কিন্তু কত দিন তরলে চলবে, শুকনো না খেলে দাদুর যে চলে না । তিন দিন টানা তরল জাতীয় খাবার খেয়ে খেয়ে সহজ সরল দাদুর সরলতা কোথায় যেন সরে পড়ল ।
দাদু খিটখিটে হয়ে গেল । আবার যেই কে সেই । আবার সেই শুকনো খাবার, ভাজাভুজি তেলের খাবার শুরু ।
ডাক্তার বাধ্য হয়েই শীঘ্র পেট খালি হবার ঔষুধ দিয়েছে । জোলাপ দিয়েছেন আর বলেছেন বুড়োর খাবারে একটু খানি ঢেলে দিতে । বুড়ি আন্দাজে একটু করে ঢেলে দেয় আর বুড়ো দৌঁড়ায় ধানকলের
আকন্দ বনের ঝোপে ।
দাদুর এই অবস্থা, তাতে কালুয়াদের বাড়িতে এখন নিশ্চয় হাতটান চলছে । এই অবস্থায় হালুয়া ঠেকুয়া করবে কিনা কে জানে । এইদিকে আবার চাম্পুও ঘ্যাম দেখাচ্ছে ।
কাল আবার পুকুরঘাটে যাবে তো !
পড়ার বইটা খোলায় রইল আর মাথার মধ্যে এইসব চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল । পড়ার বইয়ে আর মন বসল না । খুব ঘুম পাচ্ছিল তাই বইপত্রসব গুটিয়ে ঘুমোতে চলে গেলাম ।
একদম ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেল তাসাপার্টির বাজনা শুনে । একছুটে বিহারী গলিতে হাজির হলাম । দেখলাম ছয়জন লোক মিলে ছোটো বড়ো ড্রাম বাজাচ্ছে আর একজন ব্যাঞ্জো বাজাচ্ছে ।
বিহারী গলির লোক গুলো দাঁড়িয়ে দেখছে । কয়েকটা ছেলে মেয়ে নাচছে, কালুয়াও নাচছে ।
আরে, চাম্পু না !
হ্যাঁ ঠিক দেখছি চাম্পুই বটে ! চাম্পু নাচছে নাকি হাত পা ছুড়ছে বোঝা যাচ্ছে না । কালুয়া আর চাম্পু ঠিক যেন তালে তাল মিলেয়ে নাচছে ।
কিছুক্ষণ ওদের নাচ দেখে পরে বাড়ী এসে খেয়ে দেয়ে পড়তে বসে গেলাম । বিকেল বেলা শিবপুকুর যাবো । কিন্তু চাম্পুকে তো বলায় হল না ! তাহলে কি হবে ?
চাম্পু যাবে তো নাকি !
নিশ্চয় যাবে, এই বলে মনকে সায় দিলাম ।
বিকেল হয়ে এল, পগার থেকে গান বাজনার শব্দ আসতে লাগল, এবার যাওয়া দরকার । কিন্তু চাম্পু কোথায় ! আমাকে ডাকতে এল না যে বড়ো ! এদিকে সময় তড়তড় করে বয়ে যাচ্ছে ।
এইবারে কি ডাকতে আসবে না নাকি ! একাই চলে গেল না তো আবার ! কে জানে বাবা, দুদিন ধরে ওর ব্যবহার টাও কেমন একটা কোণঘেঁষা কোণঘেঁষা টাইপের হয়ে গেছে ।
আরে বিকেল তো গড়িয়ে চলল ! আর আসবে বলে তো মনে হচ্ছে না । না না আর দেরি করা যাবে না, আমাকে একাই যেতে হবে দেখছি । চাম্পুর আশায় থাকলে চলবে না ।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম মেলাতলায় । প্রচুর লোক এসেছে , যারা পূজো করতে এসেছে তারা পূজো করছে আর যারা মেলা দেখতে এসেছে তারা মেলা উপভোগ করছে ।
আমি এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে আমাদের দলের ছেলেগুলোকে খুঁজতে লাগলাম । আর বিশেষ করে চাম্পুকে খুঁজছিলাম । কিন্তু হাজার হাজার লোকের ভিড়ে নির্দিষ্ট কাওকে খুঁজে বের করা খুব মুশকিল কাজ ।
খোজাখুজি বন্ধ করে আমি ওদের পূজো দেখতে লাগলাম । দেখলাম ভ্যানে করে আবার মাথায় করে কত ঝুড়ি আসছে, ঝুড়িতে নানা রকমের ফল, কাঁন্দি কাঁন্দি কলা, নারকেল এবং আরও কত কি !
কিন্তু চাম্পু কই ! চাম্পু না হলে প্রসাদ খায় কি করে !
আবার চাম্পুকে খুঁজতে শুরু করে দিলাম । ভাবলাম এখনও হয়ত চাম্পু আসেনি, এবার হয়ত আসবে । তাই পাড়া থেকে মেলা আসার ম্যেন রাস্তার মুখে দাঁড়ালাম ।
এখান কিছুটা ফাঁকা, লোকজন খুব কম । ওই বড়ো গুড়িওয়ালা গাছটার কাছে কয়েকটা পাড়ার ছেলেকে কিছু একটা করতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলাম, যদি চাম্পু ওখানে থাকে ।
ওদের কাছে গিয়ে কালুয়াকে দেখতে পেলাম । কালুয়া আর বিহারী গলির কয়েকটা ছেলে পটকা, ব্যোমা বাজী পোড়াচ্ছে ।
কালুয়া আছে অথচ চাম্পু নাই কেন !
চাম্পুর তো থাকার কথা । দুদিন ধরে ওরা দুজন একসাথেই ঘুরছিল, তবে এখন কি হল ।
না কালুয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখি ।! কালুয়াকে জিজ্ঞেস করাতেই সে কেমন একটা হূঁ করল ।
মুখ ভেঙ্চিয়ে বলল, " আমি কি জানি । "
আমি বললাম, " তুই জানবি না তো আর কে জানবে রে । ও তো এখন তোর জিগরি দোস্ত । "
কালুয়া বলল, " দোস্ত না ছাই ! "
"কেন রে ভাই কি হল ", আমি বললাম ।
কালুয়া বলল, " দাঁড়াতে বললাম আর কোথায় পালিয়ে গেল । বললাম দাঁড়া পটকা গুলো ভিতরের ঘরে আমার ব্যাগে রাখা আছে বের করে আনি । পটকা এনে দেখি ব্যাটা গায়েব ।
দুমিনিটও দাঁড়াতে পারলো না । বলেছিল হাতের মধ্যে ধানী পটকা ফাটানোর সময় আমার পাশে থাকবে । আর এখন নিজেই গায়েব । "
" কাল তো দিব্যি ফাটিয়েছিলি " , আমি বললাম ।
কালুয়া বলল, " কালকে চাম্পু আমার হাত টা ধরেছিল তাই সাহস পেয়েছিলাম । তাছাড়া পটকাটা কিভাবে ধরব সেটাই তো ভুলে গেছি । সকালে একবার ফাটিয়েছিলাম, এখন আর মনে পড়ছে না । "
আমি বললাম, " মনে পড়ার আবার কি আছে, পটকার গোড়োটা ধর একটুখানি । "
কালুয়া বলল, " তুই ফাটিয়ে দ্যাখা । "
ব্যস্ , আমি আর কিছুই বললাম না । চুপচাপ কালুয়ার অসহায় মুখটা দেখতে লাগলাম । কালুয়াদের পুজো এবং সে পটকা বাজীও ফাটাচ্ছে, তাসত্ত্বেও কালুয়া এত উদাস কেন ।
হাতের মধ্যে রেখে ধানী লঙ্কা ফাটাতে পারছেনা বলেই কি সে ঊদাস নাকি চাম্পুর সাথে দোস্তী ভেঙে গেছে বলে ।
কালুয়া হয়ত চেয়েছিল হাতে করে ধানী ফাটিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে, সকলকে বুঝিয়ে দেবে যে ও ভীতু নয় । কিন্তু চাম্পু না থাকায় তার আর সাহসে কুলোচ্ছে না । তাছাড়া
ভুলাক্কার কালুয়া তো ভুলেই গেছে যে কিভাবে হাতের মধ্যে ব্যোম ফাটাতে হয় ।
মনে মনে বললাম, ব্যাটা কালকে শিখল আর আজকেই ভুলে গেল ।
কিন্তু চাম্পুটা কোথায় গেল কে জানে । এখনই সন্ধ্যে হয়ে যাবে । সবাই চলে যাবে মেলা শেষ হয়ে যাবে ।
ভাবলাম আজ বোধহয় আর ভগবানের প্রসাদ খাওয়া হল না ।
আর হল ঠিক তাই । বেলা শেষ হয়ে গেল, মেলাও শেষ হয়ে গেল ।
সব নিজের নিজের বাড়ী ভেগেছে । আজ চাম্পুর ওপর খানিক রাগ হল, কারণ মেলাতলায় সবাই ইন্জয় করলো কিন্তু চাম্পুর অপেক্ষায় আমার সমস্ত ইঞ্জয় ভেস্তে গেল ।
তবু মনে একটা আশা রইল, কালুয়ার সাথে ওদের বাড়ি যাওয়া যাক । ঠেকুয়া খেতে পাবো ।
কালুয়াকে বললাম, " কি রে বাড়ী যাবি না । "
ও বলল, " দাঁড়া এই পটকাগুলো ফাটিয়ে নিই দিয়ে যাবো । "
আমি বললাম, " এ কালুয়া বলছি যে ঠেকুয়া খাওয়াবি তো ভাই । "
কালুয়া বলল, " দাদিকে বলবি দেখবি দেবে । "
আমি নিশ্চিত হলাম যে কালুয়াদের বাড়ীতে তার মানে হালুয়া ঠেকুয়া হয়েছে । কালুয়ার সাথে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
শেষে সাড়ে ছটার সময় কালুয়াদের বাড়ি গেলাম । ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি কালুয়ার দাদি হিন্দীতে নাকি ভোজপুরীতে গলা খাকরাচ্ছে, কপাল চাপড়াচ্ছে ।
কি ব্যাপার তা জানতে ইচ্ছে করল । একটু পরে কালুয়ার দাদি নিজেই বলে উঠল,
" হামারা হালুয়া কে লি গেলি রে !
কৌন হারামি খাইলিলি হামারা হালুয়া রে !
কালুয়াকে দেখে ওর দাদি গালাগাল দিতে লাগল । বলল,
" ঘার মে কাহে নেহি রাহেতা রে কালমুহা ! দারওয়াজা কাহে খোল কে রাখে গেলি । কুত্তা ঘুষকে হালুয়া লেকে ভাগ গেলি । "
কালুয়ার মনে পড়ল, সত্যি তো বেরিয়ে যাওয়ার আগে সে দরজা লাগাতে ভুলে গেছিল ।
ছিঃ ছিঃ বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছে সে ।
নিজেকেই বললাম, কালুয়ার কাছ থেকে আর কি আশা করতে পারি । ব্যাটা ভুলাক্কারের কিছুই মনে থাকে না ।
যাঃ ঠেকুয়াটাও বোধহয় হাতছাড়া হয়ে গেল । নিজের কপালের উপর দোষারোপ করতে লাগলাম ।
কিন্তু আমার কপাল মোটেও খারাপ ছিল না । কারণ ঠেকুয়াও পেলাম, নাড়ুও খেলাম । কালুয়ার দাদি নিজে থেকেই দিল ।
আঃ কি টেস্টি মাইরি ! কিন্তু হালুয়াটাই পেলাম না । তাতে কোনো প্রবলেম নেই, ঠেকুয়া তো খেলাম ।
কালুয়ার দাদু বাড়ি ছিলনা, ফিরে এসে দুর্ঘটনার কথা শুনে খানিক চেঁচামেচি করে একদম চুপ করে গেল আর নরম নাড়ু চিবোতে লাগল । শক্ত ঠেকুয়া চিবানোর দাঁত বহুদিন আগেই খুইয়েছে ।
তবে ছোলার ডালের নরম হালুয়া খেতে খুব ভালোবাসে বুড়ো । কিন্তু বুড়োর ভাগ্যে আজ হালুয়া নাই কারন হালুয়া গায়েব হয়ে গেছে ।
কুকুর কি বেড়াল ঢুকে হালুয়া খেয়ে গেছে । কিরকম রাক্ষস কুকুরবেড়াল যে এক খাঞ্চা হালুয়া সাঁটিয়ে দিল ।
মিনিট খানেক পর কালুয়ার দাদির ক্ষীণ আর্তনাদ শুনতে পেলাম । ছোট্ট চালা মতো রান্নাঘর থেকে বুড়ি চেঁচাচ্ছে,
" এ কালুয়া ইধর শুনত জারা । দেখতো বেটা বো জুলাবওয়ালা বোতালওয়া কাঁহা হেঁ । মুঝে দিখ না রাহী । "
কালুয়া একটা খালি কাঁচের বোতল দাদিকে দিল ।
কিন্তু বোতল খালি দেখে দাদি অবাক হয়ে গেল ।
বলল, " এ বোতল নেহি রে । দুসরি বোতল হোগা দেখ । "
কালুয়া আরও একটা বোতল বুড়ির হাতে দিয়ে বলল, " আউর কোয়ি বোতল নাহি হ্যায় । "
বিস্মৃত হয়ে কালুয়ার দাদি দ্বিতীয় বোতল থেকে কি একটু চেখে নিল । তারপর বলল,
" আরে ইঁ তো শাহাদওয়া হ্যায় । "
এই বলে বুড়ি আবার কপাল চাপড়াতে লাগল । বুঝলাম বুড়ি কিছু একটা ভুল করেছে যার জন্য এরকম করছে ।
পরে অবশ্য জানতে পারলাম বুড়ি হালুয়াতে মধু দেওয়ার বদলে ভুল করে জোলাপের পুরো শিশিটাই ঢেলে দিয়েছে ।
বুড়িও যে কালুয়ার মতো ভুলাক্কার ! না না বয়স হলে মানুষ একটু আকটু ভুল করে বসে । যাক্ গে ভালোই হয়েছে ।
ভাগ্যিস্ হালুয়া খাইনি । খেলে কি যে হত তা আর জানতে কারও বাকি নাই । ভালোই হয়েছে কুকুর বেড়ালে খেয়েছে ।
এবার গিয়ে ঠেলা বুঝবে যখন উন্মত্ত পেট নিচের দিকে ঠেলা দেবে ।
মনে মনে হ্যাঃ হ্যাঃ করে হেসে ফেললাম ।
কালুয়াদের বাড়ি থেকে অনেক্ষণ হল চলে এসেছি । পাড়ার বন্ধুদের সাথে ঢিলো খেলতে লাগলাম । সবথেকে অবাক হলাম যখন
এখানেও চাম্পুকে দেখতে পেলাম না । চাম্পুই তো আমাদের এই ঢিলো খেলার প্রধান আয়োজক , তবে সে কোথায় ।
আমি সবসময় চাম্পুর দিকেই থাকি ।
ওর সাথে থাকলে ভয়ানক জায়গাতেও লুকোতে আমার ভয় করে না । কিন্তু এখন তো চাম্পু নাই, তাহলে কোথায় লুকানো যায় ।
সানু কুতুব আর আমি ঠিক করলাম ধানকলে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকব ।
ধানকলের দিকে ছুটলাম আমরা তিনজন । ধানকলে ঢোকার পথে ওই ভাঙা পাঁচিলটার দিকে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম । ভাঙা পাঁচিলটার ওখানটা খুব অন্ধকার
আর সেই অন্ধকারে পাঁচিলটাতে একটা কালো মুর্তি বসে আছে । আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে মুর্তিটা । বাকিরাও দেখল আর সানু তো থরথর করে কাঁপতে লাগল ।
আমার বুকটা ধড়াক্ ধড়াক্ করতে লাগল, ভাবলাম ভুত নাকি !
এমন সময় মুর্তিটা ভীষণ চাপাস্বরে বলে উঠল,
" তোরা এখানে কি করছিস রে কুতুব ! "
একি ভুতটা কুতুবকে চেনে দেখছি । খানিকক্ষণ পরে আবার কালো মুর্তিটা বলে উঠল,
"তোরা ঢিলো খেলছিস নাকি রে ! আমিও খেলব !"
আমার গা টা শিরশির করে উঠল । কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেলাম । কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দিশাহারা চিত্ত দিশা ফিরে পেল যখন কুতুব বলল,
"তুই এখানে কি করছিস চাম্পু ! একা একা এই অন্ধকারে বসে কি করছিস তুই ! "
চাম্পু !
হ্যাঁ চাম্পুই বটে ।
কিন্তু চাম্পু এখানে কি করছে । মেলাতলায় গেল না আবার কালুয়াদের বাড়িতে গিয়েও পালিয়ে গেল । কি ব্যাপার কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ।
আর এখানেই বা কি করছে সে । কেন জানিনা ওর উপর একটু সন্দেহ হল । আমি চাম্পুকে বললাম,
" তুই মেলা দেখতে গেলি না কেন রে !"
চাম্পু কিছুই না বলে চুপ করে থাকল ।
আমি আরও বললাম, " জানিস্ চাম্পু কালুয়াদের হালুয়া কুকুরে খেয়ে নিয়েছে আর..."
আমার কথা শেষ না হতেই চাম্পু কেমন যেন কুকুরের মতো ঘেঁউ করে উঠল ।
সে বলল, হ্যাঁও ! তুই কি জানিস রে । কুকুরে খেয়েছে না ছাই ! হালুয়া কালুয়াই খেয়েছে !
এই বলে চাম্পু পেট ধরে উঁহঃ উঁহঃ করতে লাগল ।
চাম্পু কেন এমন বলল যে কালুয়াই হালুয়া খেয়েছে । অথচ সে তো নিজের চোখে দেখেনি ।
আমার সন্দেহটা আগেই হয়েছিল আর সেটা এখন সম্পূর্ণ হল ।
সমস্ত কিছু আমার কাছে জলের মতো সাফ হয়ে গেল । কিন্তু চাম্পু ভাবছে আমি কিছুই জানি না ।
কিন্তু আমি জানি যে, চাম্পু কেন আজ মেলাতলায় যায় নি । আমি জানি, কেন সে কালুয়ার সাথে মিলঝোলটা এত বাড়িয়েছিল ।
কি কারণে চাম্পু এই সাঁঝের বেলায় ধানকলে অন্ধকারে পাঁচিলে বসে আছে, সেটাও আমি জানি ।
যেই ধানকলে আমরা রোজ সকালে আর বিকেলে পেট খালি করতে আসি হাল্কা হতে আসি সেখানে চাম্পু অবেলায় কি কারনে, তাও জানি ।
এবং এও জানি, কেনই বা চাম্পু পেটটাকে চেপে ধরে উঁহঃ উঁহঃ করছে ।
কুকুরে হালুয়া খেয়েছে বলাতে, কথাটা নির্ঘাত চাম্পুর গায়ে লেগেছে । জোলাপ দেওয়া হালুয়া খেয়ে চাম্পুরই হালুয়া টাইট হয়ে গেছে গ্যারান্টির সাথে বলতে পারি ।
আর তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ব্যাটা । জীবনে আর কোনো দিন হালুয়া খাবে বলে তো মনে হয় না ।
আমি নিজের মনে বললাম, ব্যাটা নিজে খাবে, নিজে চুরি করবে আর লোকের দোষ দেবে । একদম ঠিক হয়েছে! বেশ হয়েছে ! খাসা হয়েছে !
আবার বলে কিনা, হালুয়া খেয়েছে কালুয়া । ।
এখানে ক্লিক করে আমার ফেসবুক প্রোফাইলে ঘুরে আসতে পারেন ।

No comments:
Post a Comment