গিরগিটির খপ্পরে
আলীম খান
শনিবার দিন স্কুল হাফবেলা ছুটি হয়ে যায় । আজ শনিবার তাই হাফবেলায় ছুটি হয়ে গেল ।
সব ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে যে যার বাড়ীর দিকে দৌড় দিল ।
ঝন্টুও তার ভারী ব্যাগখানা পিঠে নিয়ে রওনা দিল বাড়ীর উদ্দেশ্যে । ঝন্টুর বন্ধু পটা আজ স্কুলে গ্যাপ দিয়েছে,
তাই ঝন্টুর মন খারাপ, তাকে একা একা বাড়ী ফিরতে হবে । আজ অঙ্কের ক্লাসে সবকটা অঙ্ক ঠিক করাই স্যারের বাহবা পেয়েছে,
তাই মনের আনন্দে শিস্ বাজাতে বাজাতে বাড়ীর দিকে হেঁটে চলেছে ঝন্টু । তারপর আবার বিকেল বেলায়
পগারের ছেলেদের সাথে ক্রিকেট ম্যাচ আছে । সুতরাং ঝন্টু আজ খুব উৎসাহিত ।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আধেক পথ চলে এসেছে তা বোঝায় গেল না । পথ চলার সময় এদিক ওদিক না দেখলে তার একদমই চলে না ।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশের লোকজন কি করছে না করছে, এরকম যতসব ছাইপাস দেখা ঝন্টুর স্বভাবদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
তবে মাঝেমধ্যে অবশ্য রাস্তার পীঠস্থলের দিকেও নজর রাখতে হয় আর তা নাহলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায় । কারণ রাস্তায় যেখানে সেখানে খাল, গর্ত-টর্ত আর ইঁট-পাথর তো পড়ে রয়েছেই ।
একদিন হয়েছিল কি ঝন্টু একেবারে ঠিক হারুর চায়ের দোকানের সামনেই হোঁচট খায়, একখানা আধলা ইঁটে পা লেগে যায় আর তারপর ব্যালেন্স করতে পারিনি সে ।
ব্যাস্ ওমনি চিৎপটাং ! আর তা দেখে চায়ের দোকানের সব কটা লোক ফ্যাঁকফ্যাঁক করে হেসেছিল ।
"আহা ! কোথাও লাগেনি তো বাবা !"
কোথায় না এরকমটা বলে একটু সহানুভূতি দেবে, তা না করে লোকগুলোকে ফ্যাঁকফ্যাঁক করে
খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে দেখে ঝন্টুর খুব রাগও হয়েছিল সেদিন ।
আর ঠিক সেই কারণে ঝন্টু বরাবর রাস্তা দেখে চলাফেরা করে ।
গাছপালা পশুপাখি দেখতে দেখতে ঝন্টুর চোখ গেল একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে ।
গাছটাকে দেখতে দেখতে ঝন্টু ভাবখেয়ালি হটখেয়ালি হয়ে পড়ল । মনে মনে বলতে লাগল,
"আহা ! কি সুন্দর, কি দারুণ ফুল ফুটেছে ! লাল রঙের ফুল ও সবুজ রঙের পাতা মিলেমিশে গাছটাকে কি অপূর্বই না লাগছে ।
যেন প্রকান্ড এক রঙিন ছাতা । "
গাছের ছাওয়ায় খুব ঠান্ডা ও মনোরম ।
তাই ঝন্টু গাছের ছাওয়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, ঠান্ডা ছাওয়ায় মনোরম আমেজকে উপভোগ করতে লাগল ।
কিন্তু হঠাৎ একটা জিনিসের দিকে চোখ পড়তেই ঝন্টুর সমস্ত আনন্দ উল্লাস উচ্ছ্বাস এক নিমেষে কোথায় যেন ফুরুৎ করে উড়ে পালিয়ে গেল ।
মুখের মধ্যে আশঙ্ক্ষার ছাপ পরিস্কার দেখা দিল যেন তার চোখ দুটো অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে ।
গাছের প্রকান্ড গুড়িটার ঠিক মাঝখানটাতে ওটা কি !
ভালো করে দেখতেই ঝন্টু পরিস্কার বুঝতে পারল যেমনটা সে আশা করেছিল ঠিক তাই ।
ওটা একটা গিরগিটি !
চোখ পাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে ঝন্টুর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । ঝন্টু ভয় পেল ।
ভীত ক্ষিপ্ত হয়ে ঝন্টু হাত দিয়ে তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল,
" হেঁই ! হেঁই ! যা ! যা ! "
কিন্তু ঝন্টুর রোষের প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করল না গিরগিটিটা ।
সে যেন আরও বেশি বেশি করে চোখ পাকাতে লাগল
আর মাঝেমাঝে দুএকবার মুন্ডুটা উপরনীচ করে হুমকি দিতে লাগল ।
যেন বলতে লাগল,
তোকে এবার বাঁচাবে কে !
কে বাঁচাবে তোকে !
হাপিস করে দেবো !
সব চালাকি বের করে দেবো !
ঝন্টুর হূঁশ যায় যায় আরকি ! মুহুর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল গত পরশু দিনের সেই হরিবল্ ঘটনা ।
পরিস্কার চোখের সামনে ভেসে উঠল সদ্য ঘটে যাওয়া সেই বুক কাঁপানো বিষয়টা ।
তাহলে কি আনোয়ার ঠিকই বলেছিল আমিই ভুল ছিলাম, এমনটাই ভাবতে লাগল ঝন্টু ।
সেদিন ঝন্টু তার চোখের সামনে একটা জ্যান্ত গিরগিটিকে মরতে দেখেছে ।
ওই অবলা প্রাণীটার গলায় ফাঁস লাগিয়ে ল্যাম্পপোষ্টে টাঙিয়ে দিয়েছিল বেলতলার আনোয়ার ।
পটকিয়ে পটকিয়ে মেরেছিল অসহায় নিরীহ জীবটাকে । ঝন্টু প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি ।
গিরগিটিটার প্রাণ বাঁচাতে পারেনি সে ।
আনোয়ার ঝন্টুর থেকে বয়সে অনেক বড় এবং দেহাকারে ঝন্টুর ডবল ।
তাই প্রতিবাদী ঝন্টুর বিদ্রোহ, সংগ্রাম আর লড়াই ধোপে টেঁকেনি,
সবটাই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে ।
সেদিন আনোয়ার বুক ফুলিয়ে জোর গলায় বলল "ওকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করিলাম ।
ওর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে, ওকে আমার রক্তের দাম দিতে হয়েছে । "
এসব কথার কিছুই ঝন্টু বুঝতে উঠতে পারে নি ।
ঝন্টু জিজ্ঞেস করল, রক্তের দাম মানে !
তুমি কিসব বলছ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
তুমি শুধু শুধু গিরগিটি টাকে মেরে ফেললে, ও তোমার কি দোষ করেছিল ।
আনোয়ার একেবারে কটমট কড়মড় করে উঠেছিল ঝন্টুর উপর ।
বলল দোষ মানে, চরম অপরাধ করেছে এই গিরগিটি ! এই শয়তান !
এ আমার রক্ত খেয়েছে । আমার রক্ত কি সস্তা নাকি !
ঝন্টু অবাক হয়ে বলল, ও কি তোমাকে কামড়েছে !
- আরে না না ! ও কি কামড়াবে ! ওর বাপের সাধ্য নাই আমাকে কামড়ানোর !
- তাহলে, জিজ্ঞাসু হয়ে ঝন্টু বলল ।
- তুই তো দেখছি কিছুই জানিস না রে ঝন্টু ! এই জন্যই বলি আড্ডায় একটু আধটু বসবি ।
ঘরে বসে থাকলে চলবে কি করে, তুই যে বড় হচ্ছিস,
তোর এসব জানা উচিত ! এগুলো স্কুলে শেখাবে না, বুঝলি । তাই বলছি মাঠের আড্ডায় আসবি,
তোর জ্ঞান বাড়বে, আনোয়ার বলল ।
ঝন্টু উত্তরে হ্যাঁ বা না কিছুই বলে নি, খালি ফ্যালফ্যাল করে আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে ছিল আর কিছুটা ভাবুক হয়ে পড়েছিল ।
আনোয়ার বলল, বুঝতে পারলি না তো ! শোন তবে পুরো বিষয়টা তোকে খুলে বলি ।
আনোয়ার ঝন্টু কে যা যা বলেছিল তা ঠিক এইরকম :
দুপুরে পেট পুরে খেয়ে দেয়ে আনোয়ার তখন মাঠের এক ধারের ওই উঁচুমত ঢিবিটাতে হাত দুটোকে বালিশের মতো ভাঁজ করে
তাতে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল । পকেটে ভাজা মটর নিয়ে এসেছিল,
কুটুর কুটুর করে ওই মটর চিবোচ্ছিল । এমন সময় সে অনুভব করল যে তার শরীর টা গরম হয়ে আসছে ।
হাত দুটো চিন্ চিন্ করছে । মাথা ঘুরছে, হাত দুটো অবশ হয়ে আসছে ।
কিন্তু কেন !
হঠাৎ কেন এরকম হতে লাগল তা কিছুতেই আনোয়ার বুঝতে পারছিল না ।
তার মনে হল কেউ যেন তার শরীরের বহুমূল্য রক্ত চঁ চঁ করে টেনে নিচ্ছে ।
সে সামনের দিকে, ডানদিকে, বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখল কিন্তু কোনোকিছুই দেখতে পেল না ।
এবার পিছন দিকে ঘুরতেই সে যা দেখল তাতে আনোয়ারের মাথার
ঘিলুটা গব্ গব্ করতে লাগল । কারন পাশেই শুকিয়ে যাওয়া ন্যাড়া আকন্দ গাছটার একেবারে মগডালে একটা গিরগিটি ।
আর সেটা স্থিরভাবে একদৃষ্টিতে আনোয়ারকে দেখছে । গিরগিটি তার মুন্ডুটা উপরনীচ করে চলেছে ।
এমন সময় তার ধূসর গলাটা টকটকে লাল রঙে পরিবর্তিত হতে লাগল ।
আনোয়ারের বুঝতে আর দেরি হল না যে এই শয়তান গিরগিটিটাই তার রক্ত চুষে খাচ্ছে ।
বিলম্ব না করে আনোয়ার একটা ঢিল ছুঁড়ে দিল শয়তানটার দিকে ।
দুর্দান্ত টিপ তার, এক ঢিলেই গিরগিটি ভ্যাট ।
ঝন্টু চোখের পাতা এক করল । তারপর যা যা ঘটেছে সবই তার নিজের চোখে দেখা ।
এসব দেখে শুনে ঝন্টু হতভম্ব হয়ে পড়েছিল কারণ এর আগে সে এরকম
কিছু বাপের কালে দেখেওনি আর শোনেওনি । পুরো বিষয়টাই তার কাছে গাঁজাখুরি মনে হয়েছিল ।
কারন ঝন্টু জানত আনোয়ার কিসব আজেবাজে ছাইপাশ খাই, নেশা করে ।
ঝন্টু অনেকবার দেখেছে মাঠের পাশের কচুবন টাই ভোঁস ভোঁস করে কি সব টানতে আর ধোঁয়া ছাড়তে ।
হয়ত তখনও সে নেশা করেছিল, হতেও তো পারে ।
সেদিনের এই ঘটনাটা ঝন্টুর মাথার চারধারে চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে লাগল । সেই ভয়ঙ্কর হত্যালীলা
চলচ্চিত্রের ন্যায় তার চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাক হতে লাগল । হঠাৎ ঝন্টু সেই ভাব জগৎ থেকে ইহজগতে ফিরলো ।
হুঁশ ফিরতেই ঝন্টু দেখতে চাইল যে কৃষ্ণচূড়া গাছটিতে গিরগিটিটা রয়েছে কিনা ।
হ্যাঁ ওটা ঠিক তার আগের জায়গাতেই রয়েছে আর সেটা স্থিরদৃষ্টিতে ঝন্টুর দিকেই তাকিয়ে আছে ।
এবার ঝন্টু পুরোপুরি ভীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ল ।
সেদিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে । এবার শিকার আনোয়ার নয় স্বয়ং ঝন্টু ।
এই আশঙ্কায় ঝন্টুর মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল । তাহলে কি এবার ঝন্টুর পালা ।
কিন্তু সেদিন তো আনোয়ার গিরগিটি টাকে মেরে ফেলেছিল । এটা কি অন্য গিরগিটি, নাকি ওটাই ।
এই চিন্তা মাথায় আসতেই সে হকচকিয়ে গেল । কারণ সেদিনের হত্যাকান্ড ঘটেছিল ঠিক এই জায়গায়,
তবে কয়েক গজ দূরে আর ওই ল্যাম্পপোষ্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল ।
আরে এই তো ল্যাম্পপোষ্ট, ঝন্টু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে ।
কিন্তু যেই জিনিসটা সে দেখতে চেয়েছিল
সেটা কিন্তু ওই ল্যাম্পপোষ্টে ছিলনা ।
মানে গিরগিটি উধাও ।
ঝন্টুর চোখে মুখে এক মহাশঙ্কার ছাপ । সে আবার গাছটার দিকে তাকালো । এবার যা দেখল তাতে ঝন্টুর গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল ।
গিরগিটিটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে, রোগা পাতলা গিরগিটিটা কুনো ব্যাঙের মতো ফুলে গেছে ।
তা দেখে ঝন্টুর শ্বাস প্রশ্বাস ওটানামা করতে লাগল, হাঁপানি হলে যেমনটা হয় ।
ঝন্টুর গলা শুকিয়ে কাঠ । কি করবে বুঝতে পারছে না । এবার ঝন্টু পরিস্কার দেখল গিরগিটি তার গায়ের রঙ পাল্টাচ্ছে,
গলা থেকে ঘাড় অবধি টকটকে লাল হয়ে গেছে আর চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে তীরের ফলার মতো ।
এসব দেখে ঝন্টুর শরীরটা অসাড় হয়ে গেল । মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল । গা গুলোতে লাগল, পা দুটো নিজেথেকেই কাঁপতে লাগল ।
ঝন্টু মনে মনে ভাবতে লাগল, তার মানে আনোয়ার ঠিকই বলেছিল । সত্যি সত্যিই গিরগিটি মানুষের রক্ত চুষে খায় ।
এটাই সেই শয়তান গিরগিটিটা, আবার জ্যান্ত হয়ে গেছে । ওরা কখনও মরে না, ওরা শুধু মারে ।
ও শিকার করতে বেরিয়েছে, মানুষ শিকার ।
না না কিছু একটা করতেই হবে ।
নাহলে যে অকালে প্রাণটা যাবে ।
রাগ ভয় ক্রোধ মিলে মিশে ঝন্টুর মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন দেখা গেল । সহজ সরল ঝন্টু এখন যেন এক হিংস্র জীব ।
ক্ষিপ্ত ঝন্টু কি যেন খুঁজতে শুরু করে দিল । ঝন্টু পাথর ঢেলা খুঁজতে লাগল । সে একটা ইঁটের টুকরো হাতে নিয়ে
সজোরে ছুড়ে দিল গিরগিটিটাকে লক্ষ্য করে । কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না । গিরগিটি অক্ষত তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়নি ।
আবার ঝন্টু কয়েকটা ইঁটের ঢেলা হাতে তুলে নিল আর একটার পর একটা ছুঁড়তে লাগল । একটা ঢিল মনে হল তার লেজে লেগেছে
কারণ ফুরুৎ করে গিরগিটিটা কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেল ।
ঝন্টু ভাবল, গিরগিটি ভয়ে পেয়েছে তার কাছে হার মেনেছে, তাই ল্যাজ গুটিয়ে ধাঁ । তার জয় হয়েছে আর শয়তানের পরাজয় ।
নিজের উপর তার গর্ব হতে লাগল ।
কিন্তু না, পরক্ষণেই ঝন্টুর সমস্ত গর্ব মাটি ধুলো বালি ছাই হল ।
গিরিগিটি আবার ফিরে এসেছে । ও পালায় নি,
ও ভয় পায়নি । এবার একেবারে ঝন্টুর সম্মুখে এসে মুন্ডুটাকে লাগাতার উপর-নীচ করতে লাগল ।
এবার বোধ হয় চরম কিছু ঘটবে, শয়তান তার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে ।
ঝন্টুর শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল । ঝন্টুর মনে সংশয়, এখানে থাকলে তার প্রাণনাশ ঘটবেই ঘটবে ।
শয়তান গিরগিটিটার সাথে সে পেরে উঠবে না কারণ গিরগিটির ক্ষমতা অপার । শেষমেষ নিজের প্রাণটাই যাবে ।
কিন্তু ঝন্টুকে কিছু একটা করতেই হবে, আর তা নাহলে...
ঝন্টু আর ভাবতে পারল না ।
বেগতিক দেখে ঝন্টু দৌড় লাগালো । পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই । কাধেঁ ভারী ব্যাগ আর পায়ে চপ্পল তা সত্ত্বেও ঝন্টু দৌড়চ্ছে ।
রাস্তার ধারে সারি সারি শিশু গাছগুলো পিছনে ফেলে এগিয়ে চলল সে । শংকরদের বাঁশবনটাও পার হল সে । কিন্তু তার দৌড় আর থামল না ।
প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে প্রাণ হাতে নিয়ে সে দৌড়চ্ছে । আজ কোনো বাঁধা তাকে আঁটকাতে পারবে না ।
কোথাও কেউ নেই । ভরদুপুর রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
এই সময় ঝন্টু পটাকে খুব মিস করতে লাগল । পটা থাকলে হয়ত এই অবস্থা হত না । আজ সে বড় একা ।
চপ্পল পরে ভালো করে দৌড়তে পারছে না, স্লিপ কাটছে । হঠাৎ সে রাস্তায় পড়ে গেল হাতটা আর হাঁটুটা একটু ছোঁড়ে গেল,
একটা চপ্পলের ফিতে খুলে গেল । তার ওপর ভারী ব্যাগটা পিঠের উপর ধড়াস্ ধড়াস্ করে আছড়ে পড়ছে, ব্যথা হচ্ছে ।
কিন্তু তাতে কি !
আজ ঝন্টুকে এই টুকু কষ্ট সহ্য করতেই হবে নাহলে অকালে প্রাণটা খোয়াতে হবে । পায়ের জুতোজোড়া সে বাঁহাতে নিল
আর ডান হাতটা বাঁকিয়ে ব্যাগটাকে চেপে ধরল ।
ব্যস্ তারপর আবার দৌড়তে শুরু করল । আর বেশি পথ নেই । সামনেই হারুর চায়ের দোকান,
সেখানে পৌঁছতে পারলেই হল । একটা গভীর দৃঢ় শ্বাস নিয়ে এক দমে ছুট দিল,
একবারের জন্যও সে পিছন ফিরে তাকালো না ।
আর একটু... আর একটু... আর একটু...
ব্যস্ আর না !
ঝন্টু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । সে এখন হারুর চায়ের দোকানের সামনে এসে পড়েছে ।
আর চিন্তা নেই, বিপদ কেটে গেছে । চাওয়ালা হারু ঝন্টুকে হাঁপাতে দেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,
" কিরে রে ব্যাটা কি হয়েছে । দৌড়াচ্ছিলি কেন বাবা ! রাস্তা দেখে চল্ ব্যাটা
নাহলে সেদিনকার মতো আবার হোঁচট খাবি যে ! "
ঝন্টুর খানিক রাগ হল কিন্তু সে জবাব দিল না । আসল কথা হল ঝন্টু কথাই বলতে পারছিল না ।
ও হাঁপাতেই ব্যস্ত । বেচারা ঝন্টু নির্বাক হয়ে রইল ।
একমাত্র ঝন্টুই জানে যে তার সাথে কি ঘটতে চলেছিল ।
আর কেউ এসব বুঝবে না কারণ যার হয় সেই বোঝে ।
পরদিন সকালে পটা ঝন্টুদের বাড়ীতে এসেছে ঘুড়ি উড়োতে । ঝন্টু আগের দিনের সমস্ত ঘটনাটা পটাকে বলল ।
কিভাবে সে শয়তান গিরগিটির হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছে । সব শুনে পটার চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল আর মুখটা হাঁ হয়ে রইল ।
পটা ঝন্টুর পিঠে হাল্কা চাঁপড় দিয়ে ঝন্টুকে তার সাহসিকতার জন্য সাবাসী দিল ।
তারপর দুজনাতে বাড়ীর ছাদের একধারে ঘুড়ি উড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
ছাদের অন্য ধারে ঝন্টুর ছোটো কাকা ব্যায়াম আর কসরত করছিল ।
এমন সময় ঝন্টু হঠাৎ আঁতকে উঠল ।
সে কি যেন একটা দেখেছে । ছাদে ওঠা সিঁড়িঘরের কার্ণিসে ওটা কি !
টিকটিকি... না ওটা টিকটিকি নয় । টিকটিকি তো ওভাবে মাথাটা দুলোয় না । চোখ পাকিয়ে একভাবে ঝন্টুর দিকেই তাকিয়ে আছে । এটা সেই শয়তান গিরগিটি টা । রক্তচোষা গিরগিটি । সে আবার রক্ত খেতে এসেছে, শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে নিতে এসেছে ।
ঝন্টু প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল । গিরগিটিটাকে মারার জন্য উদ্যত হল । ছাদের এককোণে পড়ে থাকা কাক তাড়ানো লাঠিটা দিয়ে গিরগিটিটাকে মারতে গেল ।
এমন সময় ছোটো কাকা ঝন্টুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
একি রে ঝন্টু । এ কি করছিস ! কেন ওকে মারতে চাইছিস্ !
ওই নিরীহ গিরগিটিটা তোর কি দোষ করল !
ও আমার রক্ত খেতে এসেছে, ঝন্টু বলল ।
একথা শুনে ছোটকা হো হো করে হেসে ফেলল ।
ছোটো কাকাকে এভাবে হাসতে দেখে
ঝন্টুর মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল আর পটাও হতভম্ব ।
কে বলেছে ওরা রক্ত খায় ! কোন পাগল ছাগলদের কাছ থেকে এসব শুনেছিস, কাকা বলল ।
তাহলে ওর গলাটা, বুকটা লাল হয়ে যায় কেন ! আর কেনই বা আমার শরীর টা অবশ হয়ে আসছিল, ঝন্টু বলল ।
ছোটোকাকা চিন্তিত হল । ঝন্টুর এইরকম অপ্রীতিকর ভুল ভ্রান্তি ভাঙাতেই হবে । নাহলে সে বিপজ্জনক কুসংস্কারে ডুবে যাবে ।
ছোটোকাকা কখনও এমনটা হতে দিতে পারে না ।
ছোটোকাকা ঝন্টুকে বোঝালো :
গিরগিটি একপ্রকার নিরীহ সরীসৃপ প্রাণী । ওরা মানুষের রক্ত খায় না, ওরা প্রধানত কীটপতঙ্গভোজী । ওরা গায়ের রঙ পরিবর্তন করতে পারে, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য গায়ের রঙ পাল্টিয়ে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করে ।
বিশেষ করে প্রজনন কালে পুরুষ গিরগিটির গলা থেকে পেট অবধি লালচে কালো রঙে পরিবর্তন হয় এবং গলা ফুলিয়ে স্ত্রী গিরগিটিকে
আকর্ষিত করে । তাছাড়া শত্রুদের ভয় দেখানোর জন্যও ওরকম করে থাকে ।
তবে কি জানিস এক ধরণের গিরগিটি আছে যারা জল শুষে নেয় তবে মুখ দিয়ে নয় পায়ের চামড়ার মধ্য দিয়ে । জলের ওপর পা রাখা মাত্র
কিছুক্ষণের মধ্যে জল আপনাআপনি মুখ পর্যন্ত চলে যায় । আরও এক ধরণের গিরগিটি আছে যারা শত্রু নিবারণের কারনে চোখ দিয়ে
রক্তের ফোয়ারা বের করে যাতে শত্রু ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় ।
তাই আবার বলছি যে গিরগিটি মানুষের রক্ত চোষে না ।
আর তোর শরীরটা অবশ হয়ে গেছিল কারণ তুই খুব পেয়েছিলিস ।
ভয় পেলে সব মানুষেরই গা গুলোয়, আবার অবশ অবশ ভাব হয় বুঝেছিস ।
ঝন্টু তার কাকার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনল এবং বিশ্বাসও করল । কারণ ছোটোকাকা মিথ্যে কথা বলে না । ছোটোকাকা সদ্য বি. এস.সি
অনার্স কমপ্লিট করেছে । প্রাণী বিশেষজ্ঞ না হলেও অনেক কিছুই জানে ঝন্টুর ছোটোকাকা । লজ্জা পেয়ে ঝন্টু এক বার পটার দিকে তাকালো
আর তারপর আকাশে দিকে তাকিয়ে কেটে যাওয়া ঘুড়িটা দেখে বলে উঠল,
ভোঁ কাটা ! ভোঁ কাটা ! প্যাকেট কর্ আর বেরিয়ে যা !
Written By :- Aalim Khan

No comments:
Post a Comment