"তালগাছে বেতাল"
আলীম খান
হঠাৎ ঘুরতে যাওয়ার একটা প্লান করে ফেলল চাম্পু । তবে কোনো বড়সড় ট্যুর নয়, কাছেপিঠে কোথাও একটা ছোট্ট সাইকেলজার্নি মাত্র।
আমি চাম্পুর কথায় সায় দিয়ে বললাম, " ঠিক বলেছিস ভাই, অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি । ভালোই হবে ! কাল রবিবার, ছুটির দিন ! তবে কোথায় যাবি কিছু ঠিক করে রেখেছিস্ নাকি ? "
চাম্পু বলল, " যেদিকে মন চাইবে সেইদিকে চলে যাবো ! "
আমি বললাম, " ওয়াণ্ডারফুল ! আই লাভ ওয়াণ্ডারিং ! "
চাম্পু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, " দ্যাখ ভাই আর কাওকে বলিস্ না যেন, শুধু আমি আর তুই, ঠিক আছে !"
আমি বললাম, " ঠিক আছে ! "
গতকাল যা কথা হয়েছিল সেইমতো সকাল ৯টার আগেই আমি রেডি হয়ে মাঠে চলে এসেছি । ৯টা বেজে ২০ মিনিট হয়ে গেল কিন্তু চাম্পু তো এখনও এল না ।
ভুলেটুলে যায়নি তো আবার । আমি চিন্তিত হলাম না কারন চাম্পুর ক্যারাক্টারে এরকম অনেক দোষ আছে । আর তারমধ্যে একটা হল ফাজলামী করা এবং কথার খেলাপ করা ।
আসবো আসবো বলে না আসা এবং যাবো যাবো বলে না যাওয়া, এটাই তো ওর স্বভাব ।
চাম্পু কারো কথা শোনে না, আবার কাওকে মানেও না ।
বড়দের সম্মান করতে ওর গায়ে লাগে । অনেক বলে করে গালাগাল দেওয়াটা কম করিয়েছি । একেবারে যে কটুকথা বলা ছেড়ে দিয়েছে সেটা বলা খুব অন্যায় হবে ।
আগে একটা কথা বলার পর দুটো করে জোরালো গালাগাল খিস্তি করত, তবে ইদানিং তা একটুখানি কমেছে বলাবাহুল্য ।
বোধহয় বয়স হচ্ছে তাই একটু শুধরেছে আর তার সাথে ব্যাটার জ্ঞানবুদ্ধিও একটু আকটু হচ্ছে ।
কিন্তু যেতে দেরি করলে ফিরতেও যে দেরি হয়ে যাবে এই বুদ্ধিটা কি চাম্পুর এখনও হয়নি নাকি !
আমি ঢাকগাছের ছাওয়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাক্ করতে লাগলাম ।
চাম্পু সাইকেল আনতে বারণ করেছিল তাই খালি হাতে এসেছি । টাকা আনতে বলেছিল, কিন্তু একটাকাও নিই নি । তাছাড়া টাকা কোথায় পাবো ?
চাম্পু জিজ্ঞেস করলে মিছিমিছি বলে দেবো, হ্যাঁ নিয়েছি !
চাম্পু স্কুল থেকে দুদিন আগে সাইকেল পেয়েছে । অবশ্য পেয়েছে না বলে ছিনিয়ে নিয়েছে বলাটাই শ্রেয় কারন চাম্পু সাইকেল পেলে আমাদেরও সাইকেল পাওয়ার কথা । আসলে ছাত্রদের দেওয়ার জন্য সবুজসাথী প্রকল্পের সাইকেলগুলোকে একটা ষ্টোর রুমে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হেডমাষ্টারমশাই ।
বিদ্যালয়ের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফাইনাল-ডে যেদিন হবে সেদিন বিজেতাদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষে পুরস্কার দেওয়ার সাথে সাথে সাইকেলগুলোও বিতরণ করে দেওয়া হবে ।
প্রতি বছর সেই মাঘ মাসের শুরুতেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়ে যায় কিন্তু এবছর কি একটা অজানা কারনে প্রতিযোগিতার তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
সেই ফাল্গুন মাসের ১৭ তারিখে সাইকেল দেওয়ার কথা । কিন্তু চাম্পুর তড় সয় নি । চাম্পুর কথামতো সে নাকি জোরদার প্রতিবাদ করে উঠেছিল ।
একটাই দাবি ছিল ইম্মিডিয়েটলি তার সবুজসাথীকে তার হাতে তুলে দিতেই হবে । চাম্পুর অধিকারের সাইকেল স্কুলকে দিতেই হবে । আর তা নাহলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবার হুমকিও নাকি দিয়েছিল চাম্পু ।
এই দাবি মানতে স্কুলকর্তৃপক্ষ প্রথমে নারাজ হলেও পরে হেডমাষ্টারের স্পেশাল পারমিশনে শেষ পর্যন্ত গোপনে সাইকেল হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছিল স্কুল কমিটি । চাম্পুর কাছে কমিটি নতিস্বীকার করেছিল ।
অবশ্য এসব কথার এতটুকুও আমি বিশ্বাস করিনা কারন বাং দেওয়া আর গুল্ মারার স্বভাব বাংমাষ্টার চাম্পুর বহুদিনের পুরোনো ।
বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে চাইলে অথবা বাংমাষ্টারী শিখতে চাইলে চাম্পুর কাছে স্বল্পমেয়াদি ট্রেনিং নিলেই যথেষ্ট ।
হঠাৎ চাম্পুর গলা পেলাম, হিন্দী সিনেমার কি একটা গান গাইতে গাইতে তার সবুজসাথীতে চড়ে আমার দিকেই আসছে ।
আমার কাছে এসেই বলল,
আমি অবাক ! চাম্পু বলে কি ? সবেমাত্র এসে বলছে নাকি অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট্ করছে ।
আমি বললাম, " তুই তো এই এলি, আমি নটার আগেই এসেছি । কই তোকে দেখতে পেলাম না তো ?"
চাম্পু ভ্রূ উঁচিয়ে বলল, " তুই ৯টায় এলি আর আমি সেই ৮টায় এসেছি ।
তুই আসছিস্ না দেখে তেলিপুকুরে ঢুঁ মেরে এলাম । বিস্তর মাছ হয়েছে পুকুরে, বুঝলি । খালি মুখ তুল হঁপ হঁপ করছে । ভাবছি একদিন ছিপ ফেলবো । "
আমি চাম্পুর সাথে তর্কে না গিয়ে বললাম, " তেলিয়াদের চিনিস্ তো, ধরলে পরে ঠ্যাং কেটে নেবে ! "
আমার কথা শোনামাত্র চাম্পু মুখটা কেমন যেন কুঁচকে গেল । চোখ কপালে তুলে কি যেন ভাবতে লাগল ।
বোধহয় সেইদিনের কথাটা ভাবছে যেদিন মাছ ধরতে গিয়ে ধরা পড়ে রামক্যালানি খেয়েছিল । তেলিয়ারা মারেনি ঠিকই, কিন্তু ওরা চাম্পুকে ধরে এনে আমাদের ক্লাবের হাতে তুলে দিয়েছিল ।
ক্লাবের ছেলেরাই চাম্পুকে কেঁলিয়েছিল । নিশ্চয় সেই কথাটাই ভাবছে ব্যাটা।
চাম্পুর ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, " কি রে চাম্পু কি হল ? "
সম্বিত কাটতে না কাটতে চাম্পু বলে উঠল, " আমার আবার কি হবে । "
এই বলে চাম্পু তার সাইকেলের বেলটা ক্রিং ক্রিং করে দুবার বাজিয়ে দিল । আমি বুঝলাম চাম্পু যাওয়ার জন্য একদম রেডি ।
আমি বললাম, " দে চাম্পু আমি চালায় ? "
চাম্পু ফট করে বলে উঠল, " না না আমি চালাবো তুই বোস । "
"তোর সাইকেলটা কেমন চলছে ভাই", আমি কেরিয়ালে বসে জিজ্ঞেস করলাম ।
চাম্পু উত্তর দিল না । আমি বাড়ির ফোন আর হেডফোন দুটোই নিয়ে এসেছি গান শুনবো এবং ফটো তুলবো বলে ।
চাম্পুর সবুজসাথী এগিয়ে চলল শহুরে পাকার রাস্তার উপর দিয়ে । মনে হল কোনো সাইকেলে নয় যেন মোটরসাইকেলে বসে আছি ।
আমি আরাম করে চাম্পুর পিছনে বসে বিড়বিড় করে গান গাইতে লাগলাম । হঠাৎ চাম্পুও একটা গান ধরল । তাই আমি চুপ করে গেলাম । পকেট থেকে হেডফোনটা বের করে কানে গুঁজে দিয়ে একখানা ঝাম্পুটিয়া গান চালিয়ে দিলাম । চাম্পুর গান আর শুনতে পেলাম না ।
গান শুনতে শুনতে বেখেয়ালী হয়ে পড়েছিলাম । চাম্পু মাঝেমধ্যে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কিসব বলতে লাগল । আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে ' হ্যাঁ.. হুঁম্..' দিয়ে চললাম ।
এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল । আমি পুরোপুরি গানের জগতে চলে গিয়েছিলাম, এমন সময় হঠাৎ চাম্পু ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল । হঠাৎ করে এভাবে জোরে ব্রেক কষায় আমার কপালটা চাম্পুর পিঠের হাড়ে ঠোকা লাগল । চাম্পু হাল্কামতো আর্তনাদ করে উঠল ।
আমি বললাম, " কি হল চাম্পু দাঁড়িয়ে গেলি কেন ?"
চাম্পু বলল, " আগে সামনে তাকা ! "
আমি তাকালাম আর তাকাতেই অবাক হলাম । এ কোথায় নিয়ে এল চাম্পু । কোন অজপাড়া গাঁয়ে এসে পড়েছি আমরা । গ্রাম বলাটাই ভুল ! নিরন্তর ফাঁকা জমি খাঁ খাঁ করছে, চাষটাষ হয় বলে মনে হচ্ছে না । কোথাও কোনো বাড়িঘর চালাকুঠি কিছুই দেখা যায় না । অনেকটা দুরে এক পাল গরু ছাগল চড়ে বেরাচ্ছে তবে রাখালছেলে বোধহয় বাড়ি ফিরে গেছে বসে বসে রোদ পোয়ানোর মতো সময় এটা নয় ।
শীতকাল সেই কবে কেটে পড়েছে ।
একটা আধপাকা রাস্তা সোজা উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে গেছে । কোনো একসময় এই রাস্তা পাকা ছিল কারন এখানে সেখানে পিচ ঢালা পাথরের অবশিষ্ট মাঝে মধ্যে চোখে পড়েছে । বোধহয় প্রখর সূর্য্যের তাপে বেশিরভাগ পিচ বাষ্প হয়ে উবে গেছে আর পাথরকুচিগুলো সব স্বেচ্ছায় অদৃশ্য হয়ে গেছে নতুবা কালের অতিক্রমণে কালো পাথর ধূসর মাটিতে রূপান্তরিত হয়েছে ।
মোবাইলে সময় হয়েছে সাড়ে দশটা । চাম্পু নিজেই বলল, " চ সামনের দিক থেকে একটু ঘুরে আসি । " আমি ইশারায় হ্যাঁবাচক উত্তর দিলাম ।
কিন্তু পাকা রাস্তা আর কাঁচা রাস্তার মধ্যে আশমান জমিন ফাঁরাক । এই ধরনের রাস্তা একজন আরোহীকেই কাহিল করে দেয় । তার উপর আবার আমরা দুইজন ।
আমাকে নিয়ে টানতে টানতে মাত্র দশ কি পনেরো মিনিট হবে হয়তো এরমধ্যেই চাম্পু হাত খাঁড়া করল । তার মানে এবার বোধহয় আমাকে টানতে বলবে ।
এই মরেছে ! আমি টানবো এই মেঠো বালিময় রাস্তায় ! দুই মিনিটেই হার্টফেল করবো ! না না আমি টানবো না ! এই রাস্তায় আবার সাইকেল চালানো যায় নাকি । এতে কেবল গরুর গাড়িই চলতে পারে । গরুদের আবার হাত খাঁড়া করার উপায়টাও নেই !
হঠাৎ চাম্পু আমার বাঁ কাঁধে ওর ডান হাতটা রাখল আর বাঁ হাতটা নিজের বাঁ হাঁটুতে রেখে মুখটা হাঁ করে হাঁপাতে লাগল ।
আর আস্তে করে বলল, " ভাই খুব পিয়াস লেগেছে রে ! দ্যাখ তো কোথাও কলটল আছে নাকি ?"
চাম্পুর এই অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল । আমি জলের সন্ধানে চতুর্দিকে তাকাতে লাগলাম । কিন্তু কোথাও কোনো কল-কূপ-কুয়ো কিছুই দেখতে পেলাম না । চাম্পুর এই অসহায় পরিস্থিতিতে একটু সহায়তা নিশ্চয় করা দরকার । তাই হেডফোনটা গুটিয়ে নিয়ে ফোনটা পকেটে পুরে নিয়ে বললাম, "চাম্পু তুই বোস আমি চালায় । চল একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায় । যদি কোনো গাঁ টাঁ দেখতে পায় সেখানে জল খেয়ে বাড়ির দিকে রওনা হবো । "
চাম্পু হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না তবে চট করে সাইকেলের কেরিয়ালে বসে পড়ল ।
শেষ পর্যন্ত আমাকে হাত লাগাতেই হল । আমি সাইকেল টেনে নিয়ে এগিয়ে চললাম । সত্যি এইরকম মেঠো রাস্তায় সাইকেল চালানো দুঃসাধ্য ব্যাপার । মাত্র পাঁচ সাত মিনিট চালাতে না চালাতেই আমারও হাল চাম্পুর মতো হল । প্রচন্ড তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল । এটা গরমকালও নয় তবুও প্রচন্ড গরম লাগতে লাগল । শরীরের সব জল ঘাম হয়ে বেরিয়ে গেল । কিন্তু তবুও কোথাও কোনো গ্রামের হদিশ মেলে না । মনে হতে লাগল এই রাস্তা যেন সোজা জাহান্নাম্ পর্যন্ত গেছে । এই রাস্তা দিয়ে গেলে সোজা যমদুয়োরে পৌঁছে যাবো ।
আমি আর সাইকেল চালাতে পারলাম না । দাঁড়িয়ে পড়লাম, হাঁপাতে লাগলাম । একটুখানি হলেও জল দরকার । গলাটা না ভেজাতে পারলে বোধহয় আর কথা বলতে পারবো না ।
চাম্পু আর আমি পরস্পরের মুখের দিকে অসহায় ভাবে তাকাতে লাগলাম । এ জায়গা আমাদের একদম অচেনা । কটা বাজল দেখার জন্য ফোনটা বের করলাম । দেখলাম বেলা এগারো টা পার হয়েছে । আমাদের দুজনারই অবস্থা প্রায় মৃতপ্রায় আর শোচনীয় । আমরা দুজনায় ভালো করে কথা বলতে পারছিলাম না । একটু ছাওয়ায় বিশ্রাম করা দরকার । কিন্তু এই রাস্তার ধারে ছোট ছোট ঝোপজাতীয় কাঁটা গাছ আর বাবলাগাছ ছাড়া আর কোনো রকমের বড় গাছ গাছ দেখা যায় না । দূরের জমিতে কয়েকটা গাছ দেখা যাচ্ছে ।
অনতিদূরে একটা মাঝারি উচ্চতার তালগাছ একপায়ে ভর দিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে তবে আকাশে উঁকি মারছে কিনা বুঝতে পারছি না ।
এই বলে ছাওয়াটাই যেই বসতে যাবো ঠিক তখনই চাম্পু বলল, " আরে কি করছিস এখানে বসিস্ না ! দেখছিস্ না কত কাঁটা পড়ে আছে ! পিছনে এমন কাঁটা ফুটবে যে দুচারদিন আর কোথাও বসতে পারবি না । "
একদম ছোটবেলায় একটা কথা প্রায় শুনতে পেতাম,
" বাবলা গাছে বাঘ ঝুলছে ।
বাবলা গাছে বাঘ ঝুলছে । "
বাঘ স্বেচ্ছায় গায়ে কাঁটা ফোটানোর জন্য কেন বাবলা গাছে চড়তে যায় কে জানে ! নাকি বাবলা কাঁটা বাঘের চামড়া ভেদ করতে পারে না । কোনো বিশেষজ্ঞ পশুবিদই বলতে পারে ।
যাক্ গে আমি বাবলা গাছের ছাওয়ায় আর বসলাম না ।
তালগাছটা খুব বেশি দূরে ছিল না, খুব জোর দেড়শো দুশো মিটার হবে ।
চাম্পু বলল, " ওখানে একজন লোক দেখতে পাচ্ছি বসে বসে কিছু একটা করছে । "
কিন্তু আমি কাওকে দেখতে পেলাম না । বললাম, " কোথায় লোক ? "
চাম্পু বলল, " ভালো করে দ্যাখ্ ?"
আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম । দেখলাম কালো মতো কি একটা ওখানে নড়াচড়া করছে । আমি বললাম, " ওটা ছাগল রে পাগল !
ও বলল, " তোর মাথা ! "
এই বলে তালগাছটার দিকে হাঁটতে লাগল । আমি সাইকেলটা নিয়ে চাম্পুর পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলাম ।
বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে যখন তালগাছটার অনেকটা কাছে এসে গেলাম তখন পরিস্কার দেখলাম সত্যিই কালো মতো রোগাপাতলা একটা লোক তালগাছের গোড়ার কিছুটা দূরে মাথা ঝুঁকিয়ে কি একটা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ।
চাম্পুর চোখ আছে বলতেই হবে, পুরো ঈগলের চোখ !
আমরা ধীরে ধীরে লোকটার পৌঁছে গেলাম । তালগাছের ছাওয়াটা একটুখানী ছোট বৃত্তের মতো জায়গা জুড়ে রয়েছে ।
সেইখানটাতে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে লাগলাম আর চাম্পু মাটিতে বসে পড়ল ।
আর দেখলাম সেই কালো মতো লোকটা মাটির ভাঙা হাঁড়ির টুকরো গুলোকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছে ।
লোকটা আমাদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরেই ছিল ।
চাম্পু বলল, " লোকটা তালগাছে হাঁড়ি বাঁধতে এসেছে । "
আমি বললাম, " তালগাছে হাঁড়ি বেঁধে কি হবে ? "
চাম্পু বলল, " তাঁড়ি হবে । "
লোকটা তখনও মাথাটা নিচু করে বসেছিল । এত কালো লোক আমি আগে কোনো দিন দেখিনি । কালো মোষের থেকেও কালো । এখনও পর্যন্ত লোকটার মুখটা দেখিনি । লোকটা একবারও আমাদের দিকে তাকায়নি ।
আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছি অথচ লোকটা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না কেন ? লোকটা কানে কালা নাকি ?
আমাদের উপস্থিতি কি লোকটা এখনও টের পাইনি নাকি ইচ্ছে করেই আমাদের দেখছে না । ভারী অদ্ভুত ব্যাপার !
লোকটা কালা নাকি তা পরিক্ষা করার জন্য চাম্পু একবার "ওই..." বলে খুব জোরে চিৎকার করে উঠল ।
আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তড়াক্ করে কেঁপে উঠল আর ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
লোকটার মুখটা কি ভয়ঙ্কর ! এত কালো মুখ আমি বাপের জন্মেও দেখিনি । মানুষের মুখ বলে মনেই হয়না । লোকটার মাথাটা এত ছোট কেন ?
মানুষের মাথা এত ছোট হতে পারে আগে জানতাম না, প্রথমবার দেখলাম ।
হনুমানের মাথার সাইজে লোকটার মাথার সাইজটা । একটা সবুজ রঙের ময়লা গামছা দিয়ে নেংটি বেঁধেছে । গায়ে আর কোনো কাপড় নেই । আদিবাসী সাঁওতাল টাঁওতাল হবে হয়ত ।
গাছে হাঁড়ি বাঁধতে এসেছে নিশ্চয় নাহলে ওভাবে নেংটির মতো করে গামছাটা পড়বে কেন, গাছে ওঠার আগেই তো ওভাবে নেংটি বাঁধে লোকে ।
মাটির হাঁড়িখানা ভেঙে গেছে তাই বোধহয় চিন্তিত হয়ে পড়েছে । সেই চিন্তায় হয়ত আমাদের খেয়ালই করেনি ।
কিন্তু চাম্পুর চিৎকারে লোকটা অদ্ভুতভাবে আমাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল তারপর হঠাৎ ভাঁঙা হাঁড়ির টুকরোগুলো ফেলে দিয়ে একলাফে তালগাছের গোঁড়ায় পৌঁছে গেল ।
একি !
লোকটা যে দেখতেই খালি হনুমানের মতো নয়, এ যে আবার পুরো হুনুর মতোই লাফায় ।
আশ্চর্য্য !
লোকটা কি আমাদের দেখে ভয় পেল । তাহলে অমনটা করল কেন ?
চাম্পুর অতো জোরে চিৎকার করাটা মোটেই ঠিক হয় নি । বোধহয় লোকটার পিলেখানা চমকে গেছে ।
গাছের গোঁড়াটাকে আঁকড়ে ধরে লোকটা আমাদেরকে চোখ ফেঁড়ে ফেঁড়ে দেখতে লাগল আর কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে দ্রুত ডানদিকে বাঁদিকে একবার তালগাছের চূড়োর দিকে একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে কি যেন পরিক্ষা করতে লাগল ।
চাম্পু বলল, " দাঁড়া লোকটাকে জিজ্ঞেস করি তাড়ি পাওয়া যাবে নাকি ! "
"তাড়ি ! সে তো নেশা ভাঙ", আমি বললাম ।
চাম্পু প্রতিবাদ করে বলল, " তোর মুন্ডু ! ওটা গাছের রস । খেলে পেট পরিস্কার হয় মাথা ঠান্ডা থাকে । দেখিস না আদিবাসীরা কেমন ঠান্ডা মেজাজী হয় । সবই তাড়ির সুফল । "
আমি বললাম, " গরমকালে না হয় তারি খেয়ে মেজাজ ঠান্ডা থাকে তাহলে বাকি ঋতুতে কি খেয়ে মেজাজ ঠিক রাখে শুনি । "
চাম্পু বলল, "তুই এসব বুঝবি না । তুই কি কোনোদিন খেয়েছিস ? খেলে পরে বুঝতিস ! এক ঋতুই খেলে ছয় ঋতুর কাজ করে ! "
চাম্পুর সাথে তর্কে গিয়ে কোনো লাভ হবে না তাই আমি আর কিছু বললাম না ।
কেন জানি না লোকটাকে আমার মোটেই ভালো লাগল না । লোকটার চোখগুলো কেমন যেন অক্ষিকোটর থেকে পুরোটাই বেরিয়ে এসেছে । লোকটার মুখটা যতবার দেখছি ততবার আমার গা টা শিরশির করে উঠছে ।
কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে । তেষ্টাটা আর তেমন নেই, যেন আপনাআপনিই তৃষ্ণা মিটে গেছে কিন্তু গলাটা যেন আরো শুকিয়ে আসছে ।
চাম্পু লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, " একটু তাড়ি হবে কাকা ! কত করে হাঁড়ি ?"
লোকটা কোনো উত্তর না দিয়ে ঠিক আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল ।
মনে মনে বললাম লোকটা পাগল টাগল না তো ! ক্ষেপে গিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে বোধহয় ।
চাম্পু আবার বলে উঠল, " কি গো কাকা তাড়ি পাওয়া যাবে ? "
আবার সেই এক কেস্ । লোকটা চুপচাপ ।
চাম্পু আমাকে বলল, " মনে হয় বাংলা বোঝে না । "
চাম্পু ভালো হিন্দী বলতে পারে তাই হিন্দীতে বলে লোকটাকে বোঝানোর চেষ্টা করল । কিন্তু কোনো সুফল হল না ।
লোকটা বাংলা বোঝে না আর হিন্দীও বোঝে না । বাংলায় থাকে অথচ বাংলা জানে না বোঝে না !
সত্যিই আশ্চর্য্য লোক বটে ।
সাঁওতালী ভাষায় ট্রাই করলে কেমন হয় । কিন্তু তার জন্য সাঁওতালী ভাষা জানা লাগে ।
স্কুলের আদিবাসী বন্ধুদের মুখে অনেক সাঁওতালী কথা শুনেছি । সবগুলো মনে পড়ছে না ।
তবে যেই একটা দুটো মনে পড়ছে সেইগুলো দিয়েই চালিয়ে দিই যদি কোনো ভালো ফল পাওয়া যায় ।
তাই চাম্পুকে বললাম, " দাঁড়া আমি ট্রাই করে দেখি । "
লোকটার দিকে চেঁচিয়ে সাঁওতালীতে বললাম,
" আমকো চিলকা মেলামা " দা আগুইপে ।"
তবুও তার কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না । চাম্পু আমার মুখে শোনা কথাগুলো জোরে জোরে রিপিট করতে লাগল,
" হামকো চিলকা মেলামা, দা হাগুইপে !
হামকো চিলকা মেলামা, দা হাগুইপে ! "
এতদ সত্ত্বেও লোকটার কাছ থেকে কোনো সদর্থক প্রতিক্রিয়া পেলাম না । সে তার পূর্বাবস্থায় অটল রইল । আমাদের কাছে আর কোনো উপায় রইল না ।
আমরা সিদ্ধান্তে এলাম যে লোকটা একটা আস্ত পাগল ।
কেন জানি না চাম্পুও হঠাৎ যেন পাগলে মতো আচরণ করতে লাগল । বিভিন্ন ভঙ্গিতে লোকটাকে রাগাতে লাগল । অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে লাগল । কিন্তু তবুও লোকটা কিছু না বলে গাছটাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল । অত বড়ো লোকটা চাম্পুকে ভয় পাচ্ছে দেখে চাম্পু হাতের ক্যালিতে ঘুসি পাকাতে লাগল । খালি হাতে ঢেলা ছোড়ার ভঙ্গি করতে লাগল ।
লোকটা খুব ভয় পেয়ে গেছিল কারন একদন্ড দেরি না করে লোকটা দ্রুত তালগাছে চড়তে লাগল । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটা বড়ো বড়ো তালবাগড়ার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
ভয় পেলে লোক পালিয়ে যায় কিন্তু এ যে দেখি গাছে উঠে পড়ল ।
অনেক পাগল দেখেছি, ক্ষ্যাপা দেখেছি কিন্তু এধরণের টালমার্কা লোক জীবনে প্রথম দেখলাম ।
চাম্পু বলল, " ব্যাটাকে মজা দেখিয়ে ছাড়বো । "
এই বলে চাম্পু জমি থেকে শুকনো মাটির চাঙ তুলে নিয়ে একটার পর একটা ছুড়ে মারতে লাগল তালগাছটায় । তালবাগড়াগুলো থেকে সড়্ সড়্ খড়্ খড়্ করে শব্দ হতে লাগল ।
চাম্পুও কি পাগল হল নাকি !
একটা মাটির ঢেলা যদি লোকটাকে লাগে তবে ভিড়মি খেয়ে পড়বে একেবারে জমিনে । অত উঁচু থেকে পড়লে মরে যেতেও পারে ।
এই সাধারণ বুদ্ধিটাও কি চাম্পুর নেই, নাকি ইচ্ছে করেই করছে ।
এই ধরণের পাগলামির কোনো মানে হয় ?
ওকে একবার দুবার নয় বেশ কয়েকবার বারণ করলাম । কিন্তু ও কথা শোনার ছেলেই নয় । লোকটাকে আজকে মেরেই ছাড়বে মনে হচ্ছে ।
এদিকে আবার অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে । বাড়ি ফিরতে হবে, ১২ বেজে গেছে । কোথায় এসেছি জানি না, রাস্তার দিকে খেয়াল রাখিনি ।
চাম্পু যেদিকে খুশি নিয়ে এসেছে আমারই ভুল মাঝে মধ্যে ওকে গাইড করা দরকার ছিল । এখন ফেরার পথে যদি চাম্পু বলে রাস্তা ভুলে গেছি তাহলে কি হবে ?
যা হবে দেখা যাবে ।
তার আগে চাম্পুকে বাড়ি ফেরার কথা বলি !
চাম্পুকে বললাম, " চ্ বাড়ি যাবি না নাকি ! কটা বাজে বলত ! চ্ রে !"
চাম্পু যেন আমার কথা শুনতেই চায় না ।
আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও চাম্পু তালগাছে ঢেলা মেরেই চলেছে ঠিক এমন সময় যা ঘটল তা আর মুখে বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব ।
হঠাৎ দেখলাম ঐ লোকটা তালগাছের ভিতর থেকে উঁকি মারল । তারপর একটুখানি নেমে এসেই থেমে গেল আর নামল না । লোকটাকে দেখে আমার পুরো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে দুবার কেঁপে উঠল ।
এ যেন সেই লোকটা নয় ।
তবে কে এটা ? ওর গায়ে এত কালো ঘন চুল কেন ?
একটু আগে তো ছিল না । ওরাংওটাং শিম্পাঞ্জির মতো এত বড়ো বড়ো চুল কোত্থেকে এল ? চোখগুলো কেন লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে ? ওর নাক মুখ কান কই ? লাল লাল জ্বলন্ত চোখদুটো ছাড়া মুখের আর কোনো ইন্দ্রিয় দেখা যাচ্ছে না ।
চাম্পু ভাঙা ভাঙা স্বরে কম্পিত কণ্ঠে বলল, " বাবু রে ! ওই লোকটা কোনো ক্ষ্যাপাট্যাপা নয় !
ওটা আসলে ক্ষোক্ষস ! ওটা বেতাল ! " আমি বললাম, " বেতাল মানে কি ?"
চাম্পু চিৎকার করে বলল, " বেতাল মানে ভূত ! পালা...! "
এই বলে চাম্পু সাইকেল ঘুরিয়ে দৌঁড় লাগাল ।
'ভূত' শোনামাত্র আমি আর একদন্ডও না দাঁড়িয়ে চাম্পুর পিছনে দৌড়তে শুরু করলাম । চওড়া আলের রাস্তার উপর দিয়ে যত জোরে সম্ভব আমরা দৌড়তে লাগলাম ।
দৌঁড়তে দৌঁড়তে প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেলের সীটে চড়ে উঠল চাম্পু । আর আমি তিড়িংবিড়িং করতে করতে যাহোক করে সাইকেলের কেরিয়ালে বসে পড়লাম ।
আর একটু হলেই চাম্পুর ব্যালান্স বিগড়ে গিয়ে ওখানেই চিৎপটাং হয়ে যেতাম আমরা । কিন্তু চাম্পু দুর্দান্ত ক্যালিতে সাইকেলটাকে সামলে নিল । তারপর কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে প্রাণপনে টানতে লাগল । বুকের ভিতরটা প্রচুর জোরে ধকধক করতে লাগল ।
আমি বলতে লাগলাম, " চাম্পু জোরে চালা ! আরোও জোরে চালা ! "
যত শক্তি ছিল সবটাই প্রয়োগ করল চাম্পু । তার সবুজসাথী গরগর করে মেঠো রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ।
চাম্পু পথ ভুল করেনি । শেষে একটা লোকালয়ে এসে চাম্পু সাইকেলটা ধিমা করল আর ভয়ঙ্করভাবে হাঁপাতে লাগল । বাকি পথটা আমিই টানলাম । খুব জোর বেঁচে গেছি ।
বাড়ি এসে মায়ের বকা খেয়েছি, ভয়ে দু দিন ঘর থেকে বের হয়নি । পরে আতঙ্ক কাটলে পরে মাঠে যখন খেলতে গেলাম তখন পাড়ার ছেলেদের মুখে শুনলাম চাম্পুর নাকি খুব জ্বর । বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না ।
খালি উল্টোপাল্টা বকছে । খেলা শেষ চাম্পুদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম চাম্পু ঘুমোচ্ছে । চাম্পুকে এই অবস্থায় দেখে চাম্পুর মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে । তিন দিন পরও জ্বরটা ছাড়ল না । ঘুম থেকে উঠেই চাম্পু শিউরে যাচ্ছে আর যা তা বকছে ।
পাড়ার মসজিদ থেকে মৌলানা সাহেবকে ডেকে গা ঝাড়ানো হল, পানিপড়া খাওয়ানো হল, গলায় একখানা তাবিজ বেঁধে দেওয়া হল । কিছুদিনের মধ্যেই চাম্পুর অবস্থা ফিরে এল । দেখতে দেখতে চাম্পু আবার সেই পুরোনো চাম্পু হয়ে গেল । কিন্তু একটা জিনিস এখনও গেল না । মাঝেমধ্যেই সে এক অজানা ভাষায় উল্টোপাল্টা বকে যায় । এই ভাষা বোঝা কারো সাধ্য হল না ।
আমিও বুঝতে পারি না ও কি ভাষায় বকবক করে । আমি নিশ্চিত এটা কোনো মানুষের ভাষা হতে পারে না । বেতালের ভাষা হতে পারে, তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নয় ।।
No comments:
Post a Comment