" সেই সন্ধ্যায় "
আমি বললাম, " লোক আসবে তাতে আমি কি করব !"
মা বলল, " এত কাজ একাই সামলাবো কি করে, আজ আর কোথাও যাস্ নে কথাটা শোন !"
বাড়িতে কুটুম আসবে আজ সন্ধ্যাবেলায় । সন্ধ্যে হতে এখন ঢের দেড়ি, বিকেল গড়িয়ে তারপর সন্ধ্যা আর এখন তো দুপুর ।
মা একটু রেগেই বলল, " তোকে নিয়ে আর পারলাম না । আমি কিচ্ছু জানি নে, তোর যা ইচ্ছে কর্ গে যা ! "
আমি একগাল হেসে বললাম,
এই বলে সাইকেলটা নিয়ে বেড়িয়ে এলাম রাস্তায় । শীতটা আর নেই, মনে হয় বসন্ত এসে গেছে । বসন্তের হাওয়া আমার বুকের ভিতরটাকে কেমন যেন আরও উজ্জীবিত করে দেয় । এই শীত এতদিন আমাকে জমিয়ে রেখেছিল, দমিয়ে রেখেছিল ।
কেন জানি না মনে হল বিধাতা আমাকে মুক্ত করে দিয়েছে, আর যেন বলছে কুঠির ভিতর চুপটি মেরে বসে না থেকে অনন্ত প্রান্তরের দিকে ছুটে যেতে, নিরন্ত গগনের এককোণে আনমনে প্রাণখুলে তাঁকে সুস্বাগতম জানাতে ।
শহুরে রাস্তা একদম জনশূন্য, খাঁ খাঁ করছে । লোকজন দুরে থাক, কুকুর বেড়াল গরু ছাগল কিছুই দেখা যাচ্ছে না । অবশ্য গরু ছাগলের আশা না করাটাই ভালো, তবে কুকুর বেড়ালের আশা করেছিলাম ঠিকই । আর তাছাড়া রাস্তাঘাটে কেউ থাকুক বা না থাকুক তাতে আমার কি ! আমি তো আর তাদের সাথে গল্প করতে যাচ্ছি না ।
আমি বেরিয়ে এসেছি বসন্তের আমেজকে অনুভব করতে, বসন্তের হাওয়ায় ডানা মেলতে, শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গে সেই মায়াবি স্নিগ্ধ বাতাসের ছোঁয়া লাগাতে । তাই কেউ থাকল বা না থাকল তাতে আমার কিছু যায় আসেনা ।
আকাশে হাল্কা একরাশি সাদা মেঘ কোথা থেকে উড়ে এসে মাথার ওপর এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল । তবে জানি এই মেঘে বৃষ্টি নেই তাই চিন্তার কিছু নেই । রাস্তার উপর দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে ধীর লয়ে বয়ে যাওয়া সেই স্নিগ্ধ বাতাস আমার দুই কানের লতি স্পর্শ করতে লাগল । পাতা ঝরে পরা গাছগুলো তাদের প্রায় পত্রহীন শাখা প্রশাখাগুলোকে নিয়ে মৃদু মন্থর গতিতে দুলতে লাগল ।
কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠল,
"কুহু... কুহু... কুহু !"
নিজের মনে এগিয়ে চললাম কোনো এক অজানা গাঁয়ের দিকে, যেখানে বিশাল সবুজ প্রান্তর থাকবে, গগনচুম্বি বৃক্ষতরু দন্ডায়মান হয়ে বিরাজ করবে, যেখানে আকাশ নিজেকে সাত রঙে রাঙিয়ে নৃত্য করবে ঠিক সেই দিকে ।
সাইকেলের প্যাডেল চলছে তো চলছেই । আমিও ক্লান্ত হয়নি আর আমার সাইকেলও যেন ক্লান্ত হতে চায় না । এভাবে যেতে যেতে কোথায় যে এসে পৌছালাম বুঝতেই পারলাম না । অনেকক্ষণ হল শহর ছাড়িয়ে এসেছি । এখন আমার চোখের সামনে বিস্তৃত এক খোলা মাঠ । চোখের সামনে তো দূরের কথা এমনকি দূর থেকে দূরেও কোনো লোকালয় আমার দৃষ্টিগোচর হল না । জীব জন্তু পশু পাখি কারো দেখা পেলাম না ।
যেখানে এসেছি সেই জায়গায় আগে কোনোদিন এসেছি বলে তো মনে হচ্ছে না । একটা উচু রাস্তা সুদূর পশ্চিমদিকে চলে গেছে, মনে হল ওটা বাঁধ । হ্যাঁ ঠিক ধরেছি বাঁধই বটে । উঁচু রাস্তায় উঠে দেখি ওপারে একটা নদী । নদীতে জল আছে কিন্তু যৎসামান্য আর তা ধীরে গতিতে পূর্ব দিকে বয়ে চলেছে ।
হঠাৎ দাড়িয়ে ভাবলাম ঐ রাস্তা ধরে যাবো কি যাবো না । তাছাড়া কটা বাজল কে জানে ! হাতে ঘড়ি নেয় এবং আশেপাশে কাওকে দেখতেও পাচ্ছি না যে তাঁকে সময়টা জিজ্ঞেস করি । মাকে যে বলেছি সন্ধ্যে হতেই ফিরে আসব ।
কেন জানি না মনটা খুঁৎ খুঁৎ করতে লাগল । আমার চঞ্চল মন বলতে লাগল, যা ! যা ! দাঁড়িয়ে পড়লি কেন । ওই বাঁধের রাস্তা ধরে এগিয়ে যা । এখনও সন্ধ্যে হতে বহুক্ষণ ।
ভাবলাম যাওয়ায় যাক্ না, একটুখানি গিয়ে না হয় রিটার্ণ করবো । কিন্তু কটা বাজল, তা বুঝতে পারছি না ।
হ্যাঁ না, হ্যাঁ না বলে ইতস্তত করতে করতে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলাম । এগিয়ে চললাম পশ্চিমের দিকে বাঁধের রাস্তার উপর দিয়ে । রাস্তার ধারে ধারে সারিবদ্ধভাবে বাঁধের ঢালুতে কত প্রকারের যে গাছ দাঁড়িয়ে আছে তাদের সবকটার নাম আমার জানা নেই । বিশাল বিশাল বৃক্ষের নিচে বিরুৎ আর খর্বকায় ঝোপজাতীয় গাছগুলো মাটির রাস্তার দুইধারের ঢালুকে সবুজ আচ্ছাদনে ঢেকে রেখেছে ।
দক্ষিণ পশ্চিম কোণ থেকে ম্লান রবি বড় বড় গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে ঝিলিক্ মেরে উঁকি দিচ্ছে । গাছে নানা ধরণের নাম না জানা পাখি ঐক্যতান করে চলেছে এক নাগাড়ে । শুনতে কটূ লাগলেও বেশ ভালো লাগছে । সোঁ সোঁ করে মৃদু বাতাস কানে ধাক্কা দিয়ে চলেছে যেন এই বাতাস কথা বলছে, আমার কানে কানে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু তার কথা আমি বুঝতে পারছি না । বাঁধের এপারে বিস্তৃত চাষের জমির বেশিরভাগ ফাঁকা পড়ে আছে, আবার কোথাও কোথাও শাকসব্জির সবুজ আস্তারণে জমিগুলো ঢাকা পড়েছে । এইরকম জায়গায় কোনো গবাদি পশু নেই কেন । এত ঘাস লতাপাতা তবে তা খাওয়ার জন্য
একটাও গরু ছাগল ভেঁড়া কিছুই দেখা যায় না, এ যে ভারী অদ্ভুত ব্যাপার । এই দিকটায় কেউ গরু চড়াতে আসেনা, নাকি আজ পশুরা অন্ন বয়কট করেছে ।
চারিদিকের মুগ্ধকর মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম । দেরি হয়ে গেল না তো, সময় জানারও উপায় নাই ।
সূর্যের কিরণ আর চোখে লাগছিল না । ম্লান রবি ধীরে ধীরে ডুব দিচ্ছে বোধহয় ঘুমোতে যাচ্ছে আর বলছে,
বিদায় বন্ধু ! আজ আসি, আবার কাল দেখা হবে !
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, না না আর যাওয়া যাবে না এবার বাড়ি ফেরা যাক্ ।
মন চাইল না তবুও সাইকেল ঘুরিয়ে নিলাম । মাকে কথা দিয়েছি সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ফিরব । কিন্তু এদিকে যে সাঁঝ হয়ে এল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে । আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেই হবে ।
আমার সাইকেলের চাকা দ্রুত ঘুরতে লাগল, খুব স্পীডে চলতে লাগল আমার সাইকেল । আমি দৌঁড়তে লাগলাম তবে মাটির উপর নয় সাইকেলের প্যাডেলের উপরে । আর এদিক ওদিক দেখে লাভ নাই এখন শুধু প্যাডেল করো আর করতেই থাকো ।
বেল বাজানোর দরকার নেই, রাস্তায় লোকজন যানবাহন থাকলে তবে তো বেল বাজাবো ।
রাস্তা যে একেবারে ফাঁকা, রেস করতে লাগলাম । সাইকেলের রেস, এই রেসে আমিই ফার্ষ্ট আবার আমিই লাষ্ট । জিতবো কি হারবো জানি না তবুও জানি না কিসের একটা নেশায়
আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম । কিসের একটা মনমুগ্ধকর গন্ধ নাকের ভিতর ঢুকল । এই আচ্ছন্নতায় কেন জানিনা আমি আরও জোরে জোরে প্যাডেল করতে লাগলাম ।
আমি প্রায় জ্ঞানচেতনাশূন্য হয়ে পড়ছি ঠিক এমন সময় আমার সাইকেল কিসে যেন সজোরে ধাক্কা মারল । আমি সাইকেল থেকে ছিটকে আট দশ হাত দূরে গিয়ে পড়লাম ।
আঃ ! প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হল মাথার পিছন দিকটাই । হাত দিয়ে দেখলাম ফেটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে কি না । ভাগ্যিস রক্ত বেরোয় নি । বোধহয় তক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম কারন তারপর আমার আর কিছুই মনে ছিল না ।
জ্ঞান ফিরতেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম । সন্ধ্যে হয়ে গেছে, চারিদিক প্রায় অন্ধকার । ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যেতে লাগল । সূর্য অনেকক্ষণ আগেই ডুবে গেছে ।
প্রচন্ড দেরি হয়ে গেছে, বাড়িতে ফেরামাত্র মায়ের বকা খেতে হবে কথা দিয়ে কথা রাখিনি যে ।
শিগগিরি সাইকেল তুলে রওনা দেওয়া যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে আর ভেবে লাভ কি ।
হঠাৎ পিছনে তাকাতেই আমি দেখলাম কে যেন রাস্তার ওদিকের ঢালুটাতে পড়ে আছে । মাতাল টাতাল হবে হয়ত !
এর সাথেই আমার ধাক্কা লাগেনি তো আবার ।! কে এই লোকটা !
সোজা এসে আমাকেই ধাক্কা মারল কেন ।
আমি না হয় একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তবে এই লোকটারও কি আমার মতো মাথায় ভূত চেপে গেছিল নাকি, আশ্চর্য্য !
না, লোকটাকে একবার দেখা দরকার ! বেঁচে আছে তো আবার ! মরে গেলে তো কেস খেয়ে যাবো !
এই ভেবে মনে খুব ভয় পেলাম । বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল । আগে সাইকেলটা তুলে দেখি সব ঠিক আছে কিনা তারপর লোকটাকে দেখব ।!
না না আগে লোকটাকেই দেখা দরকার ।
সাইকেলটা হাতের কাছে থাকায় আগে সাইকেলটাকেই তুলতে গেলাম ।
সাইকেল তুলতে গিয়ে দেখি,
একি !
সাইকেলটা হাত থেকে ফঁসকে গেল কেন । কি ব্যাপার !
আমি আবার সাইকেলটা তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু আবার সেই এক কান্ড । সাইকেলটা আবার ফঁসকে গেল ।
কেন জানি না আমার বুকটা ধড়াক্ করে উঠল ।
আমি সাইকেলটা স্পর্শ করতে পারছি না কেন ? সাইকেলের হ্যান্ডেলটা কেন ধরতে পারছি না কেন !
হতবাক হয়ে নিশ্চল নিঃপ্রাণ পাথরের মতো কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম । তারপর ভালো করে চোখ রগড়ে যা দেখলাম তাতে আমার অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে এলো ।
যেই লোক অথবা যুবকটা অথবা ছেলেটা আমার উল্টোদিকে মুখ করে পড়ে রয়েছে তার পরণে যেই পোশাকটা রয়েছে সেটা একেবারে হুবহু আমার মতো । তার প্যান্টটা জামাটা এমনকি জুতোটা পর্যন্ত হুবহু ঠিক আমার মতোই ।
আরে তার মাথার চুলগুলোই যে আমারই মতো । কে এই বিস্ময়কর ব্যক্তিটি । আমার সাথে তার এত মিল কেন !
ও বেঁচে আছে তো ! এক্ষুণি দেখা দরকার ।
আমার কৌতুহল চরমে পৌঁছেছে । আমি ধীরে ধীরে সেই অদ্ভুত ব্যক্তিটির সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম ।
ওর মুখটা দেখা মাত্র কিরকম একটা শৈতপ্রবাহ আমার মাথা থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে পা পর্যন্ত নেমে গেল । কারন এই চেহেরাটাও হুবহু আমার মতো ।
আমার মাথা ঘুরতে লাগল । সারা শরীরের মধ্যে রক্তের স্রোত কেমন যেন ওঠানামা করতে লাগল ।
এই বুঝি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম । আমি শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে লাগলাম । নিজেকে কোনো রকম সামলে নিলাম ।
এই ব্যক্তি আর কেউ না, স্বয়ং আমি ।
কিন্তু তা কিরে সম্ভব হতে পারে । আমি নিশ্চয় দুঃস্বপ্ন দেখছি । এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না ।
যাচাই করার জন্য আমি নিজেকে চিমটি কাটলাম, দিব্যি ব্যথা অনুভব করলাম ।
তার মানে এ স্বপ্ন নয় ।
তাহলে কি... !
আমি তখন সাইকেলটা ছুঁতে পারছিলাম না , এই নিথর নিশ্চল শরীরটাকে ছুঁয়ে দেখি কি হয় । ভয়ে ভয়ে তাঁকে ছোওয়ার জন্য হাত বাঁড়িয়ে দিলাম । কিন্তু তাঁকে আমি ছুঁতে পারলাম না ।
এটা কি করে সম্ভব হতে পারে, আমি কেন তাঁকে ছুঁতে পারছি না ।
কেন ?
তার মানে কি আমি ...?
তাহলে কি আমি মরে গেছি, আর যেটা পড়ে আছে সেটা আমারই মৃতদেহ, আমার লাশ ।
আমার বুকটা প্রচন্ড জোরে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল মনে হল, এবার বোধহয় বার্ষ্ট হয়ে যাবে । আমার দেহের প্রত্যেকটা লোম খাঁড়া হয়ে গেছে । নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঘামে আমার বুক কপাল পিঠ পুরো ভিজে গেছে ।
আমি মরতে পারি না । আমি মরতে চাই না । কি করে মরলাম আমি, কি করে এসব হয়ে গেল ।
আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না ।
নিজের চোখের সামনে নিজের লাশ দেখে আমি প্রায় পাগল হয়ে গেলাম ।
শরীরের কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, শরীরের মধ্যে এখনও জান বাকি আছে কি না ।
কিন্তু সেটা লাশ ছাড়া আর কিছুই নয়, তার মধ্যে কোনো প্রাণ নেই । হৃৎপিন্ডের ধকধকানি আর নেই ।
নাকের কাছ হাত রাখলাম কিন্তু তাতে বাতাসের কোনো প্রবাহ নেই । তাহলে কি আমি সত্যি সত্যিই মরে গেছি, আমার আত্মা আমার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ।
মৃত্যুর পর কি এরকম হয়, এমনটাই ঘটে থাকে সবার সাথে ।
আত্মা যদি আবার শরীরে প্রবেশ করে তাহলে আমি নিশ্চয় আবার বেঁচে যাবো ।
আমি আমার লাশের ওপর শুয়ে পড়লাম, শরীরের ভিতরে ঢোকার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম । কিন্তু কিছুতেই ভিতরে প্রবেশ করতে পারছি না ।
আমার শরীরে আমি ঢুকতে পারছি না কেন । এটা তো আমারই শরীর, আমি তো অন্য কারো শরীরে ঢুকতে চায় নি ।
হে ঈশ্বর এসব কি হচ্ছে !
কোথাও কেউ নেই, একটা লোকেরও দেখা পাচ্ছি না । কারো দেখা পেলে তার কাছে সাহায্য চাইতাম ।
প্রাণভিক্ষা করতাম, বলতাম যে করে হোক আমাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে ।
হাসপাতালে গেলে হয়ত ডাক্তার আমাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে । এখনকার আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক যন্ত্র আমার দেহতন্ত্রে আবার প্রাণ এনে দিতে পারে ।
এমনও তো হতে পারে, আমি এখনও বেঁচে আছি । বরং দেরি না করে কোনো মানুষের সন্ধান করা দরকার ।
কিন্তু এ রাস্তা দিয়ে এখনো পর্যন্ত কাওকে আমি দেখতে পায়নি, এদিকে কেও আসেনা নাকি ।
একটু সামনের দিকে এগিয়ে দেখি যদি কোনো লোকবসতি দেখতে পায় । আমি লোকালয়ের খোঁজে দৌড়তে লাগলাম । কিন্তু যতদূর গেলাম তাতে একটা ঘরও আমার চোখে ঠেকল না ।
আমি যত জোরে সম্ভব ততটাই জোরে চিৎকার করতে লাগলাম ।
কেউ আছো.. কেউ আছো... আমাকে বাঁচাও...
দয়া করে আমাকে বাঁচাও ।
কিন্তু কে শুনবে আমাকে, এখানে তো কেউই নেই । আমি আরও জোরে চেঁচাতে লাগলাম, যদি কেও আশেপাশে থাকে ।
আমার গলার রগগুলো যেন ছিঁড়ে যাবে আর একটু হলে, তবু আমি হাল ছাড়লাম না ।
অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে । ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কানের পোকা মরে যাওয়ার অভিপ্রায় । আমি আমার লাশের দিকে দৌড়তে লাগলাম,
ছিঃ ছিঃ লাশ বলছি কেন ! আমি এখনও মরিনি !
দেহটার কাছে পৌঁছেই দেহটাকে তোলার আবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলাম । যাকে আমি ছুঁতেই পারছি না তাকে তুলি কি করে ।
আমি কি করব ! এখন আমার কি করা উচিত ! কি করলে আবার বেঁচে যাবো ।
আমার চোখ দিয়ে অশ্রুধারার নদী বয়ে যাচ্ছে, ঘাম শরীর থেকে বন্যাকারে বয়ে যাচ্ছে ।
কেউ আসছে না কেন । দেরি হয়ে গেলে শরীরের মধ্যে আর জীবন ফিরে আসবে না ।
আমি কি করব !
হে ঈশ্বর , আমাকে বাঁচাও ! আমাকে বাঁচাও, খোদা !
আমাকে বাঁচাও !
আমি কি দোষ করেছি খোদা ! কেন তুমি আমাকে এত বড়ো সাজাহ দিচ্ছো !
রাহেম করো খোদা ! রাহেম করো !
দূরে ওগুলো কি, ওগুলো আলোর মতো জ্বলছে কেন ! ওগুলো ঘুরছে কেন !
আলেয়া নাকি !
আলো গুলো আমার দিকে আসছে কেন । লাল রঙের, নীল রঙের সবুজ রঙের আলো গুলো আসলে কি !
ঘুরপাক খেতে খেতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, কিন্তু কেন ।
ওরা কি আমাকে নিয়ে যেতে আসছে । ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে ।
স্বর্গে নাকি নরকে নিয়ে যাবে । না, আমি যাবো না । আমি যাবো না, কিছুতেই যাবো না ।
মা.... ! মা... !
আমাকে বাঁচাও মা !
আমাকে বাঁচাও !
ওটা কিসের শব্দ আসছে, আজানের শব্দ না !
হ্যাঁ হ্যাঁ আজান হচ্ছে কোথাও ! খুব বেশি দূরে না, কাছেই কোথাও মসজিদ আছে ।
কিন্তু কোথায় কোনদিকে ! দেখতে পাচ্ছি না কেন ! কোনদিক যাবো !
ওরা যে আমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রয়েছে । ওরা আরো কাছে আসছে ।
আমি এখন কি করবো । আমি মাথা ঘুরছে কেন ! আমার হাত পা সব অবশ হয়ে আসছে কেন !
আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি কেন ।
ওই আলেয়াগুলো সব এক কাছে জড়ো হচ্ছে কেন, ওরা কেন একে অপরের গায়ে গায়ে লেগে যাচ্ছে !
ওটা কে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । এই নারীমূর্তিটা কে ?
মূর্তিটা কেন আমার কাছে আসছে ! হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে আসছে কেন ।
এখন আমি কি করি । না না পালায় ! আমাকে পালাতেই হবে ।
আরে একি ! আমি দৌড়তে পারছি না কেন । কে আমার পাগুলোকে ধরে রেখেছে । আমাকে পালাতে দিচ্ছে না কেন ।
মূর্তিটা হঠাৎ আমার বাঁ হাতটা ধরে ফেলল, আমার হাতটা ধরে টানতে লাগল ।
না আমি যাবো না !
আমাকে ছেড়ে দাও !
ছেড়ে দাও বলছি ! ছেড়ে দাও !
ঘুম ভাঙলে পরে দেখলাম,
একি ! আমি তো বাড়িতেই !
মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলছে,
"এই ছেলেটা কি রে বাবা !
অবেলায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে দ্যাখো !
এ ওঠ্ ! ওঠ্ বলছি ! সন্ধ্যে হয়ে গেল, আর বাবুর এখনও ওঠার নামগন্ধ নেই !!! "
Aalim Babu

No comments:
Post a Comment