" ডুমুর গাছে ঝুমুর "
চাম্পু হঠাৎ বলে উঠল,
"আজকে দুপুর বেলায় বাঁশতলায় চলে আসবি ! কুল পাড়তে যাবো !"
চাম্পু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " কিরে বাবু ! নারকেলকুল তো অনেক খেয়েছিস আপেলকুল খেয়েছিস কোনোদিন
আমি রেগে গিয়ে বললাম, " তোর বাপ খেয়েছে তো আপেলকুল !"
চাম্পুর বিকৃত মুখ দেখে ভালোই বুঝলাম যে বাপ তুলে কথা বললে সবারই গায়ে লাগে ।
চাম্পু খ্যাঁক খ্যাঁক করে একগাল হেসে নিয়ে বলল,
" রাগ করছিস কেনে ভাই ! আগে কখনও খাসনি তবে আজকে খাবি ! হেব্বি মিষ্টি ! সলিড খেতে, খেলেই বুঝতে পারবি । "
আমি মুখটা গোমড়া করে চাম্পুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিন্তু মুখে আর কিছু বললাম না । এই ধরনের কথাবার্তা বলা চাম্পুর স্বভাব ।
ওর কাছে ভালো আর ভদ্র ভাষার আশা করাটাই ভুল । যাগ্ গে, এটা ঠিক যে আমি আগে কোনোদিন আপেলকুল খাইনি ।
আপেলকুল আবার কি রকম ধরণের কুল হয় কে জানে !
জিজ্ঞাসু চিত্তে চাম্পুকে বললাম, " আপেলকুল আবার কিরকম খেতে রে ভাই ! আপেলের মতো মিষ্টি নাকি ! "
" শুধু কি মিষ্টি, দেখলে তোর চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে বুঝলি ! এক একটা কুলের সাইজ আপেলের চাইতেও বড়ো । "
আমি বিস্ময়স্বরে বললাম, " তাই নাকি ! "
চাম্পু বলল, " একদম । রাজুকে জিজ্ঞেস কর না ! ওকে তো খাইয়েচি ! কি রে রাজু বল্ কেমন খেলি ! "
রাজু একটু অন্যমনস্ক ছিল কিন্তুর চাম্পুর হাঁক কানে যেতেই পাতি হাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করে উঠল, " সলিড খেতে ভাই ! একদম রাপচিক খেতে । "
এই বলে রাজু আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল ।
রাজুর বড়ো ভাই সানু ঝড়ের গতিতে কচুবন থেকে এসে বলল, " দেখলি তো ! আমি গেলাম আর বলটা নিয়ে চলে এলাম !
তোদের দ্বারা বল খোঁজা হবে না বরং তোরা বসে বসে ঘাস ছেড় আর খা ! "
আমি দেখলাম চাম্পু সত্যিই ঘাস ছিঁড়ছে তবে এখনও মুখে তোলেনি । কেন যে মনে হল এই বুঝি একমুঠো ঘাস চাম্পু মুখে পুড়ল বলে ।
আর যদি সত্যিই চাম্পু ঘাস খায় তাতে আমি এতটুকু অবাক হবো না । কারন আমি জানি চাম্পু সব পারে । দরকার হলে ঘাসও খেতে পারে আর
ঘাস খেয়ে দিব্যি হজমও করে ফেলবে বলে আমার পুরো বিশ্বাস ।
বলটা চাম্পুই মেরে কচুবনে পাঠিয়েছিল । ব্যাটা সোজা ব্যাটে খেলতে পারে না । আর খালি আংবাং চালায়, ভাগ্যের জোরে একদুটো লেগেও যায় ।
বল আসাতে আমাদের খেলা আবার চালু হল । বোধহয় বেলা বারোটা পর্যন্ত খেলেছিলাম ।
বাসায় এসে দেখলাম সত্যিই ঘড়িতে বারোটা বেজে গেছে আর তার সাথে সাথে আমারও বারোটা বেজে গেল ।
বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই মা পেয়ারা গাছের একটা সরু মসৃণ ডাল দিয়ে মেরে আমার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নিল । বাঁ পায়ে দুটো লাল লাল রেখা ফুটে উঠল ।
দাঁত কটমট করে মা বলল,
" লাটের বাঁট নাকি, অ্যাঁ !
সেই কোন সকালে চা মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছে হনুমান ! এখন ঘর ঢুকা হচ্ছে !
খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেবো ! পড়াশোনার মাথা খেয়ে নিয়েছে একেবারে ।
খালি টো টো করে ঘুরে বেড়ানো ।
বেরোনো বার করছি দাঁড়া !
যা শিগগির স্নান করে নে । আর খেয়ে দেয়ে ঘুমো !
দুপুরে ঘর থেকে বেড়োলে ঠ্যাং দুটো খোঁড়া করে দেবো বুঝেছো ! "
মায়ের হাতে মার খেয়ে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম । তারপর স্নানটান করে ভাত খেয়ে শোবার ঘরে মিছিমিছি শুয়ে পড়লাম । ঘুম পাবার কথায় না, আমার কোনোদিন দুপুরে ঘুম পায় না ।
জোর করে কিভাবে ঘুমোতে হয় তা আমার জানা নেই । আর তাছাড়া দুপুর বেলায় বাঁশতলায় যাবার কথা । কুল পাড়তে যাবার প্লান করেছে চাম্পু ।
বাপের জন্মে আপেলকুল খাইনি তাই তো আপেলকুল খাওয়ার ভারী স্বাদ হচ্ছে মনে । কিন্তু মায়ের শাষাণি উপেক্ষা করাটাও যে খুব সুবিধের হবে না ।
তাহলে কি করা যেতে পারে !
এক দিকে আপেলকুলের লোভ আর অন্যদিকে মায়ের মারের ভীতি এই দুইয়ের মধ্যে চরম সংঘর্ষ বেঁধে গেল ।
কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না কারন কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা বুঝতেই পারেনি ।
হঠাৎ পশ্চিমদিকের জানালার কাছ থেকে কিরকম একটা বিকট শব্দ কানে আসতে লাগল ।
ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেছে । দেখলাম জানালার পর্দা সরিয়ে চাম্পু আর সানু উঁকি মারছে
আর চাম্পু মুখ দিয়ে কিরকম একটা ভয়ানক শব্দ বের করছে । এটা কোন্ জন্তুজানোয়ারের ডাক তা ঠাহর করা মুশকিল ।
চাম্পু ফিসফিস করে বলল, " কি রে যাবি না নাকি ! আপেলকুল খাবি না ! "
তখনও আমার মনটা ভারী বিষণ্ণ তাই ভেংচিয়ে বললাম,
" যাবো না যা ! পালা এখান থেকে ! ফোট এখান থেকে !
কিন্তু চাম্পু যাবার পাত্রই না । "
পালালো না তো বটেই বরং কাকুতিমিনতি করতে লাগল ।
যেন আমি না গেলে ওর চলবে না ।
আমি বললাম, " মা আমাকে ফুলিয়ে দেবে । "
চাম্পু বলল, " লুকিয়ে চুপিচুপি পালিয়ে চ ! তোর মা দ্যাগগা এখন ঘুমোচ্ছে ! বুঝতে পারবে না চলে আয় । "
চাম্পু ঠিকই বলেছে মা এতক্ষণে নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে । এই সুযোগে ফুড়ুৎ করে পালালেই হয় ।
সেই বিকেলে যখন কলে জল আসবে তখন মা উঠবে তার আগে মা আর উঠছে না গ্যারাণ্টি ।
যায় এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি এই ভেবে আমি সড়াৎ করে কেটে পড়লাম । চাম্পু, রাজু, সানু আর আমি চারজনা মিলে বাঁশতলায় বসে পুরো প্লানটা সেড়ে ফেললাম ।
সানু রাজু দুটো চিকচিকির থলে জোগাড় করেছে । কিন্তু আমার কাছে কোনো ব্যাগ অথবা থলে নেই, চাম্পুর কাছেও নেই ।
চাম্পু বলল, " আমার জামা আর প্যাণ্টের পকেট তো রয়েছেই । "
চাম্পুর দেখাদেখি আমি বললাম, " আমারও পকেট আছে । "
যেখানে আপেলকুল পাওয়া যায় সেই জায়গাটা মোটেও কাছে নয় । প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট হেঁটে সেখানে পৌঁছালাম । একটা বিশাল দিঘির মতো পুকুরে পাড়ে এসে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম ।
এই জায়গাটাকে জঙ্গল বললেও কম বলা হবে না । চর্তুদিকে খালি বড়ো বড়ো গাছ ।
তেঁতুলগাছ পলাশগাছ নিমগাছ শিশুগাছ বেলগাছ লেবুগাছ কলাগাছ কাঁঠালগাছ পেয়ারাগাছ জামগাছ কুলগাছ । আরো হাজার রকমের গাছ, সবকটার নাম জানি না ।
"এত ফলের গাছ এই জঙ্গলে । কেউ এখানে আসে না নাকি, এই গাছের ফলটল কেউ খায় না নাকি ! " চাম্পুকে প্রশ্ন করলাম ।
চাম্পু বলল, " এটা রাজাদের বাগান ছিল । এখন ইনিভার্সিটির লোকেরা দেখাশোনা করে । "
আমি বললাম, " ওরা ফল নিয়ে যায় না । "
হঠাৎ বাঁদিক থেকে রাজু বলে উঠল, " ওরা ভীতু আছে ! ভয়ে এই জঙ্গলে ঢোকে না । "
- কিসের ভয় ।
রাজু বলল, " ভূতের ভয়, শাকচুন্নীর ভয়, পেত্নীর ভয়, ব্রক্ষ্মদৈতের ভয় বুঝলি চাঁদু !
চাম্পু বলে উঠল, " ভূত না ছাই এখানে কিস্যু নাই ! "
রাজুর কথা শুনে আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু চাম্পুর আশ্বাসে বিশ্বাস আমার আছে ।
আমি বললাম, " ওই তো কত কুলের গাছ কিন্তু কই আপেলকুল তো দেখতে পাচ্ছি না । "
চাম্পু বলল, " ওদিকে পুকুরের ওপারে গাছটা আছে ! "
পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম যেদিকে আপেলকুলের গাছটা আছে । চাম্পুর কথায় এই কুলগাছ নাকি বর্ধমানে আর কোথাও নেই । গাছের বয়স দুইশত পঞ্চাশ বছর ।
এটা রাজাদের আমলের বিলীতি কুল গাছ । রাজা উদয়চাঁদের পূর্বপুরুষরা এই গাছ লাগিয়ে বর্ধমানের লোকের উদ্ধার করেছিলেন ।
গাছেদের বয়স নির্ণয় করতে আমি জানি না, চাম্পু জানে । সব রকমের হিসেবনিকেশ চাম্পুর জানা । আমাদের মহান চাম্পু ।
চাম্পু যখন বলছে আড়াইশো বছর তবে তাই হবে হয়ত ।
আগে দেখি না কিরকম আপেলকুল তারপর না হয় বিচার করবো । গন্তব্যে পৌঁছে দেখলাম সত্যি আশ্চর্য্য রকমের কুলগাছ বটে ।
আগে কখনও এত বড়ো বড়ো কুল দেখি নি । প্রথমে ভেবেছিলাম চাম্পু আমাকে ডপ দিয়েছে । কিন্তু না, চাম্পু মোটেই ডপ দেয়নি ।
একেবারে ষোলা আনা সত্যি ।
তবে এত বড়ো কুল কিসে নিয়ে যাবো এক একটা পকেটে তো একটা কি দুটোর বেশি ধরবে বলে তো মনে হয় না তাহলে কি হবে ।
আমার জামার পকেট টা খুব ছোটো । তবে চাম্পু ব্যাগথলে কেন নিয়ে আনল না । আমাকেও বলে নি অবশ্য আমি না হয় সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু চাম্পু তো সব জানত তাহলে সে কেন ব্যাগ ট্যাগ আনেনি ।
এই প্রশ্নটা যেই ওকে করতে যাবো অমনি দেখলাম চাম্পু একখানা বড়ো পলিথিন ব্যাগ বের করল । আমি হাবাবোবার মতো চাম্পুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম ।
চাম্পু আমাকে দেখে বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দাঁত দেখিয়ে ফ্যাঁক ফ্যাঁক করে ওর স্পেশাল হাসিটা হেসে ফেলল । আমি রাগ করলাম না কারন চাম্পুর এটা স্বভাবদোষ ।
হঠাৎ পেছনদিকে তাকিয়ে দেখলাম সানু আর রাজু গায়েব । চাম্পুকে বললাম, " ওরা দুভাই কোথায় গেল রে চাম্পু । "
চাম্পু আমার কথার উত্তর দিলনা । ব্যাটা কি ফন্দি আঁটছে কে জানে ।
একটুপরেই হঠাৎ পাশের বনকচুর বড় বড় পাতাগুলো সড়সড় করে নড়ে উঠল । তাকাতেই দেখলাম দুভাই বেরিয়ে আসছে ।
ওদের জিজ্ঞেস করলাম, " কোথায় গিয়েছিলি তোরা । "
ওরা কোনো উত্তর দিল না ।
এখানে এসে এরা এরকম করছে কেন । বোবা টোবা হয়ে গেল নাকি ।
দুইভাই হাতে করে অনেকগুলো আধভাঙা আধলা ইঁট কোথা থেকে নিয়ে এসেছে জানিনা ।
দুটো করে আধলা ইঁট দুই হাতে নিয়ে দুইভাই মিলে ঠোকাঠুকি করতে লাগল ঠিক আদিম মানুষের মতো । যেমন করে আদিম মানুষরা পাথরে পাথরে ঠুকে আগুনের আবিস্কার করেছিল সেই কোন আদিম যুগে ।
আর হাজার হাজার যুগ পেরিয়ে এসে এই দুই ভাই ইঁটের সাথে ইঁট ঠুকে কি আবিস্কার করতে চাইছে ?
নতুন কিছু আবিস্কার হবে ভেবে ফ্যালফ্যাল করে ঠোকাঠুকি দেখতে লাগলাম ।
নতুন কিছু তো হলনা বরং দুটো আধলা ইঁট একে অপরকে আঘাত করে আরো কতকগুলো ইঁটের টুকরো হয়ে গেল । এর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার ছিল না ।
ছোটো ছোটো ইঁটের টুকরোগুলো থেকে দুটো করে ঢেলা হাতে নিল চাম্পু সানু আর রাজু । তারপর একসাথে ওরা গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল কুল গাছের ডালে ।
অমনি কুলগাছটা নেচে উঠল, তারপর গাছ থেকে টপাটপ কুল পড়তে লাগল । ঢিল ছোড়া বন্ধ হলে আমরা সবাই মিলে কুলগুলো কুড়োতে লাগলাম ।
খালি চাম্পু না কুড়িয়ে আমাকে পলিথিনের ব্যাগটা দিয়ে বলল, " নে কুড়ো ! "
ব্যাটা লাট সাহেবের মতো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল আর নির্দেশ দিতে লাগল,
" আরে আরে ওই তো ঐ খানটাতে একটা পড়ে আছে ! হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ খানটাতেই খোঁজ ! একটাও মিস করিস না যেন ! "
আমিও আদেশ পালন করতে লাগলাম ।
একটা কুল হাতে নিয়ে আর লোভ সামলাতে না পেরে তৎক্ষণাৎ আপেলকুলে একটা কামড় বসিয়ে দিলাম ।
আহা কি সুস্বাদু খেতে । দিব্যি আপেল খাচ্ছি মনে হচ্ছে ।
চাম্পু ধমক দিয়ে বলল, " এখন খাস নে ! পরে খাবি ক্ষণ, এখন কুড়ো দেখি । "
আমি খেতে খেতে বললাম, " কুড়োচ্ছিই তো ! দেখছিস তো ! "
আবার চাম্পুরা গাছে ঢেলা মারতে লাগল আবার টপাটপ কুল পড়তে লাগল আর আমি পটাপট কুড়োতে লাগলাম ।
আমি পকেটে যটা আঁটল ভরে নিলাম । আমরা পুরো ব্যাগ থলে পকেট সব ভরে নিয়েছি ।
এবার বাড়ীর দিকে রওনা হবো ঠিক এমন সময় কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েলি কণ্ঠে । খিল খিল করে বলে উঠল,
" কারা কুল পাড়ে রে !
এত সাহস কে দেয় রে ! "
আমি ভাবলাম এ নিশ্চয় চাম্পুর বেয়াদপি । ও ব্যাটা মেয়েলি গলা করতে পারে । আমাদের পিছনে চাম্পুই ছিল আর আমরা তিনজনা গল্প করছিলাম । তার মানে চাম্পু ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না ।
আমি বললাম, " দ্যাখ চাম্পু বেশি চালাকি মারিস না ! ইয়ারকি আমার একদম ভালো লাগে না । "
চাম্পুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাম্পু কেমন যেন ভ্রূ কুঁচকে আমাকে রাজুকে আর সানুকে দেখছে ।
দোষ করেও মুখখানা এমন করবে যেন কিছুই করেনি ।
কিন্তু চাম্পুকে একটু বেশি গম্ভীর মনে হল ।
চাম্পু বলল, " এখানে আমরা ছাড়াও অন্য কেউ আছে । আঁড়ালে আবডালে লুকিয়ে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে । "
আমরা কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম । দেখলাম চাম্পু কান খাঁড়া করে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে । আওয়াজটা এসেছিল উত্তরপূর্ব দিক থেকে ঠিক বাইশ তেইশ গজ দূর হবে ।
ক্রিকেট খেলে খেলে তা আন্দাজ হয়ে গেছে । সঠিক আন্দাজ করে বলে দিতে পারি বাইশ গজ কতটা হয় ।
ঠিক অতটাই দূরে রয়েছে একটা ডুমুর গাছ আর আশেপাশে সজনেগাছ ধুতুরাগাছ । তবে ডুমুর গাছটা লম্বায় খুব বড়ো না হলেও এত চওড়া যে অনেকটা জায়গা অধিকার করে আছে ।
পাতাগুলো এতটাই ঘন হয়ে গাছটাকে ঢেকে রেখেছে যে গাছের ওপারে কিছু দেখা যায় না এমনকি গাছের ভিতরের ডালপালা পর্যন্ত দেখার উপায় নেই ।
তার ওপর আবার কিরকম একটা লতানো গাছ পুরো ডুমুর গাছটাকে অলঙ্কারের মতো জড়িয়ে আছে যেমন করে ক্রিস্টমাসট্রি তে এল. ই. ডি. লাইট দিয়ে সাজানো হয় ঠিক সেই রকম ।
কেমন যেন মনে হল হাসিটা এই ডুমুর গাছটার কাছ থেকে এসেছিল । বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না । আবার সেই খিলখিল মেয়েলি হাসিটা শুনলাম একেবারে ওই ডুমুর গাছটার কাছ থেকেই ।
সত্যিই কেউ লুকিয়ে গাছের ওপারে আর আমাদের ভয় দেখাচ্ছে ।
চাম্পুর মাথা পুরো গরম হয়ে গেছে ইতিমধ্যে । চাম্পু বিড়বিড় করে বলে উঠল, " আমাকে ভয় দেখানো ! "
'দাঁড়া ব্যাটা' এই বলে চাম্পু চিৎকার করে বলল, " ডুমুর গাছে কে রে ? "
এক ডাকেই ওখান থেকে ভাঙা ভাঙা ক্ষণা গলায় উত্তর এল -
কেঁন রেঁ ?
তোঁর তাঁতে কিঁ রে ?
এখানে তোঁর কি চাঁই রে ?
চাম্পু ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে বলল,
" একবার বেরিয়ে আয় রে !
দেখাচ্ছি ভারী মজা রে ! "
কেন জানিনা আমার বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল ।
এক অজানা ভয়ে গা ছমছম করতে লাগল । ডুমুর গাছে কোনো মানুষ আছে, নাকি অন্য কিছু ?
এই ভেবে গায়ে কাঁটা দিল । কি ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর রে বাবা ! শুনলে পরে গা শির শির করে ।
কোন এক অদৃশ্য চুম্বকীয় আকর্ষণে গায়ের লোমগুলো খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেল । সানু আবার আমার থেকেও ভীতু । ওর মুখখানা কেমন বিবর্ণ টাইপের হয়ে গেছে ।
এদিকে চাম্পু রাগে গজগজ করছে । চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ।
চাম্পু বলল, " তুই কে ? কি চাস ?"
আবার ডুমুর গাছটা থেকে সেই ভয়ঙ্কর হাড়কাঁপানো খিলখিল হাসিটা কানে বিঁধতে লাগল ।
হিঁ... হিঁ... হিঁ... হিঁ... হিঁ... ।
ক্ষণা গলায় আবার বলে উঠল,
"আমি শাকচুন্নীর মাসি !
আমার নাম ঝুমুর ;
ডুমুর গাছে থাকি
দিন দুপুরে বাগে পেলে
নোনতা সুরে ডাঁকি !
কে আমায় দেবে ফাঁকি !!
হিঁঃ... হিঁঃ... হিঁঃ... হিঁঃ... !!
চাম্পু বলল,
" তুই যদি শাকচুন্নীর মাসি হোস, তবে আমি হলাম শাকচুন্নীর বাপ ! "
এই কথা শুনে শাকচুন্নীর মাসি আরো জোরে জোরে সেই বিকট হাসি হাসতে লাগল ।
আমি সানু আর রাজু ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম । কিন্তু চাম্পু যেন পাগলের প্রলাপ বকতে লাগল । বিড়বিড় করে কিসব বলতে লাগল, ভালো করে বোঝা যায় না ।
মন্ত্রটন্ত্র পড়ছে বোধহয় !
পড়ুক পড়ুক ! মন্ত্র পড়ুক ।
এই বিপদের সময় যদি ওর মন্ত্র শুনে শাকচুন্নীর মাসি পালায় তবে আমরা বেঁচে যাবো । না হলে সে যদি আমাদের ঘাড় মটকে দিয়ে রক্ত চুষে খায় তাহলে তো মরে যাবো ।
কিন্তু এত আস্তে আস্তে পড়া মন্ত্র মাসির কান পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে তো আবার । জোরে জোরে চণ্ডীপাঠের মতো করে পড়লে কি হতো না ! কি জানি বাবা ! চাম্পুই জানে কিভাবে মন্ত্র পড়তে হয় ।
এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি আর তাছাড়া কুল তো পাড়া হয়েই গেছে ব্যাগ আর পকেট সব ভর্তি করে নিয়েছি । তবে এখানে থেকে খামকা শাকচুন্নীর মাসির সাথে লড়াই করার কি কোনো মানে হয় !
কাঁপতে কাঁপতে চাম্পুকে বললাম, " ভাই পালিয়ে চল ! "
সানুও আমার সাথে একমত হয়ে বলল, " হ্যাঁ ভাই চাম্পু পালিয়ে চল ভাই ! "
কিন্তু চাম্পু আমাদের কথায় কান দিল না ।
উন্মাদ হয়ে এদিকে ওদিকে কি যেন খুঁজতে শুরু করে দিল ।
কি খুঁজছে ও ?
শাকচুন্নীর সাথে লড়াইযুদ্ধ করবে নাকি ! চাম্পু কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল নাকি !
আমি আবার বলে উঠলাম, " কি হল তোর চাম্পু ! ক্ষেপে গেলি নাকি রে ! "
চল্ বলছি' এই বলে চাম্পুর জামা ধরে টান দিলাম । সঙ্গে সঙ্গে চাম্পু একটা 'হুঁমঃ' শব্দ করে হাত ঝিনকিয়ে আমাকে প্রায় ঢেলেই দিল । আমি নিজেকে কোনোরকম সামলে নিলাম ।
এক্ষুণি এখান থেকে পালানো দরকার আর তা নাহলে শাকচুন্নী ভূতপেত্নীর কবলে অকালে প্রাণটা যাবে । কিন্তু চাম্পু তো যেতেই চায়না । ওকে একা ফেলে যায় কি করে । শেষে বিশ্বাসঘাতকের তকমা নিয়ে বাড়ি ফিরব ।
আমি কতটা দেশপ্রেমী আর দোস্তিপ্রেমী হতে পেরেছি তা জানি না তবে চাম্পুর পাগলামির কারনে খালিপিলি মহামূল্যবান জীবনটার সর্বনাশ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই ।
তাহলে কি চাম্পুকে ছেড়ে পালিয়ে যাবো ?
সানু আর রাজু একসাথে হঠাৎ বলে উঠল, " বাবু পালিয়ে চল ! "
হঠাৎ যেন সন্ধ্যা নেমে এল । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কোথা থেকে একরাশি ধূসর ঘন মেঘ এসে মাথার ওপর ভাসছে ।
বসন্তের শুরুতে এরকম কালো মেঘের আর্বিভাব হওয়াটা কেমন একটা অশুভসূচক বলে মনে হল । মনে হল এবার বোধহয় কোনো অঘটন ঘটবে ।
আর অঘটনটা চাম্পুই ঘটালো কতকগুলো ইঁটের টুকরো হাতে নিয়ে ধড়াধড় ছুড়তে লাগল ডুমুর গাছটাতে ।
হঠাৎ ডুমুর গাছটা একবার সড়্ সড়্ করে কেঁপে উঠল ।
তারপর অদ্ভুতভাবে গাছটা দুলতে লাগল । ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কায় গাছপালা যেমন এদিক ওদিক কাত হয়ে দুলতে থাকে ঠিক সেইভাবে ডুমুর গাছটাও দুলতে শুরু করে দিল ।
কিন্তু কোথাও কোনো ঝোড়ো হাওয়া বাতাস বয়ছিল না । তাহলে ডুমুর গাছটা এরকম করছে কেন ?
শাকচুন্নীর মাসি দেখা দিচ্ছে না কেন ? ডুমুরের ফুল নাকি ?
খানিকক্ষণ বাদে আবার সেই ভয়ঙ্কর পিলেচমকানো হাসিটা শোনা গেল । এইবার হাসিটা আরো তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ।
ভালো করে শুনে বুঝতে পারলাম এ যেন হাসি নয় বরং কান্নার শঙ্খনিনাদ ।
চাম্পুর ছোড়া ঢিল নিশ্চয় ঐ শাকচুন্নী কিংবা পেত্নীটার গায়ে লেগেছে আর সেই জন্যই সে এরকমভাবে কেঁদে উঠল । কি বিষাদময় কান্না ! এর চেয়ে ওর খিলখির হাসিটা ঢের ভালো ছিল ।
এ কোথায় এসে পড়লাম । কেন যে চাম্পুর কথায় এখানে এলাম ? এই আপেলকুলের লোভ আমাকে হুলস্থূল করে ছাড়ল ।
চাম্পুর সাথে কোনো জায়গায় যাওয়া ঠিক না । ব্যাটা যেখানে যাবে বিপদও ওর পিছন পিছন যাবে ।
একদম কুপয়া । ব্যাটা নিজেই একখানা আপদ ।
পালাবো পালাবো ভাবছি ঠিক এমন সময় শক্তমতো কি একটা সোজা কপালে এসে লাগল । প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হল ধড়াস্ করে কপালে হাতে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম ।
কপাল ফুলে আলু হয়ে গেছে কিন্তু রক্ত বেরোয়নি । মাথাটা চিনচিন করতে লাগল । হঠাৎ সানু আর রাজুর মুখ থেকে উঃ আঃ শব্দ হতে লাগল অর্থাৎ তারাও আহত । কিন্তু চাম্পু এক নাগাড়ে ঢেলা ছুড়েই চলেছে ।
হতভম্ব হয়ে দেখলাম একি ! ডুমুর গাছটা থেকে তীরের গতিতে মোটা মোটা ডুমুর ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে ।
শাকচুন্নীটা ডুমুর ছুড়ে মারছে ! প্রতিহিংসায় প্রত্যাঘাত করছে !
আমি ভয়ে প্রকাণ্ড একটা তেঁতুলগাছের গোঁড়ায় গা ঢাকা দিলাম । আমার দেখাদেখি দুইভাইও আমার পিছনে এসে লুকোলো ।
আমার বুকটা আরো জোরে ঢিপঢিপ করতে লাগল শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিটা বেড়ে গেল । সানু ও তার ভাই রাজুরও একই হাল ।
কিন্তু চাম্পু এখন হার মানেনি । ও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ।
একটার পর একটা ডুমুরের আঘাত সহ্য করেও চাম্পু এখনও ময়দানে টিকে আছে । কিন্তু ওদিক থেকে ডুমুরের গোলা বর্ষিত হয়েই চলেছে । হঠাৎ চাম্পুর ঢেলা শেষ হয়ে গেল ।
এইবার বুঝি চাম্পু ময়দান ছাড়ল বলে । কিন্তু না চাম্পু হাল ছাড়ল না ওর পলিথিন ব্যাগটা থেকে কুলগুলোকে মাটিতে ঢেলে দিল । তারপর একটার পর একটা আপেলকুল ডুমুরগাছে ছুড়তে লাগল ।
এ কি করছে চাম্পু ?
অত কষ্ট করে কুড়োনো কুলগুলো এভাবে ছুড়ছে কেন ?
তাহলে খাবো কি ?
চাম্পু মুখ থেকে 'আহঃ উহঃ হুঃ হুঃ' শব্দ করতে করতে সব কুলগুলো ছুড়ে দিল । তাতেও ব্যাটার স্বাদ মিটলো না ।
নিজের টা তো গেছেই আর সাথে সাথে সানুর ও রাজুর থলের কুলগুলোও ছুড়ে দিল ডুমুরগাছে ।
কেন যে থলে গুলো সাথে করে এখানে নিয়ে এলাম না । বড় রকমের মিসটেক করে ফেললাম ।
ওরা দুই ভাই আপষোস করতে করতে কপাল চাপড়াতে লাগল । কে জানত চাম্পু এরকম করবে । সব মাটি করে দেবে ।
এখন কি হবে । সব কুল ওই ডুমুর গাছে অথবা ঝুমুরের কাছে আছে । সেখান থেকে কুল কুড়িয়ে আনার কোনো প্রশ্নই হয়না । মনটা ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেল ।
উদাসী মন নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম । যুদ্ধ বোধহয় শেষ হয়ে গেছে কারন কোনো শব্দ পাচ্ছি না । পুরো জঙ্গলটা নিরব নিস্তব্দ্ধ ।
শাকচুন্নী পালিয়ে গেছে মনে হয়, কোনো কান্না অথবা সেই বিটখাবড়া খিলখিল হাসিটাও কানে আসছে না । চাম্পুরও চিৎকার শোনা যাচ্ছে না । কে জিতেছে কে হেরেছে বোঝার উপায় নেই ।
সব কিছু যেন থেমে গেছে । আকাশে আর কোনো মেঘ নেই, সূর্যের আলোর ছটায় পুকুরে জল ঝিলিক দিচ্ছে, নানা রকমের নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে ।
এমন সময় হঠাৎ রাজু বলে উঠল, " ভাই চাম্পুর কি হয়ে গেছে দ্যাখ । "
সম্বিত ফিরতেই দেখলাম চাম্পু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে । একটুও দেড়ি না করে দৌড়ে আমরা তিনজনায় চাম্পুর কাছে পৌঁছালাম ।
চাম্পু বেহোঁশ হয়ে গেছে । শ্বাস চলছে খুব ধীরে ধীরে ।
আমরা প্রায় একসাথে ডেকে উঠলাম, চাম্পু । এ চাম্পু !
আমি ধাক্কা দিয়ে চললাম কিন্তু তবুও চাম্পুর কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না । রাজুকে বললাম, " একটু জল নিয়ে আয় । "
রাজু একছুটে পুকুর থেকে অঞ্জলিভরে জল নিয়ে এল তারপর সেই জল চাম্পুর চোখেমুখে ঢেলে দিল । সঙ্গে সঙ্গে চাম্পু তড়াক্ করে উঠে বসে পড়ল ।
হাত দিয়ে চোখ মুছতে লাগল । বেচারা চাম্পুর মুখটা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে ।
গোটা মুখের এখানে ওখানে কালচেলাল রঙের স্পট পড়েছে । শাকচুন্নী ঝুমুর বেজায় টিপ দিয়ে ডুমুর ছুড়ে মেরেছে । চাম্পুর মুখটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ।
চাম্পুরই দোষ ! কেন শুধু শুধু ওর সাথা পাঙ্গা নিতে গেল ।
চাম্পু আধখোলা ঘোলাটে চোখে আমাদেরকে দেখতে লাগল ।
আর বলতে লাগল, " আমার কুল কই ? আমি কুল খাবো !"
আমি বললাম, "তুই রাগের মাথায় সব কুলগুলোকে কিনারায় লাগিয়ে দিয়েছিস । আমাদের একুল ওকুল সবকুল গেছে । "
চাম্পু ব্যাকুল হয়ে আমাকে কিছু বলতে চাইল কিন্তু বলতে পারল না । একদম চুপ মেরে গেল ।
আমরা চাম্পুকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে এলাম ।
কিছুদিন কেটে গেল । পরে চাম্পু একদিন বলল, " ঐ জঙ্গলে আর যাবো না ওখানে গাদা ভূত প্রেতের বাস । ওই কারনেই কেউ ওদিকে যায়না । "
চাম্পু কার কাছে জেনেছে ওই ডুমুর গাছটাতে নাকি একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল । মেয়েটার নাম ছিল ঝুমুর ।
জীবনে আর কোনোদিন ঐ জঙ্গলে ঢুকবো না প্রতিজ্ঞা করলাম ।
আজও ঐ আপেলকুলের গাছটা এখনও ওখানটাতেই আছে বোধহয় ।
তোমরা যেতে চাইলে যেতে পারো, আমি আর যাচ্ছি না ।।
সমাপ্ত

No comments:
Post a Comment