" আলুপোড়া "
"আলীম খান"
কেউ কেউ বাড়ি থেকে একটা দুটো আলু নিয়ে আসত । কেউ আবার দোকান থেকে একটাকার দুটাকার আলু কিনে আনত । আলু না নিয়ে আনলে তার এই আসরে অংশগ্রহন করার কোনো অধিকার নেই । তাই বেলা পড়তে পড়তে ভাগীদারির সংখ্যাও কমে যেত ।
বেলা শেষ আর তাই খেলাও শেষ । এবার আমাদের আদিমযুগে যাত্রা শুরু হল । সবার আলু এক জায়গায়, যে যার নিজের নিজের আলু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে । মুদ্দা কথা হল একে অপরকে শাষাণি দিচ্ছে যেন কেউ কারোর টা মেরে না দেয়, মানে সাঁটিয়ে না দেয় আরকি !
এরার পালা সরঞ্জাম জোগাড় করার । অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে তাই ভালো করে কিছু দেখা যায় না । সুতরাং হাতে যা পাওয়া গেল তাই নিয়ে সাজানো হল অগ্নিকুন্ড । কাগজ মাগজ কাঠ ফাট সব রেডি । আগুন ধরাতে হবে যে আগুন কই । সে চিন্তা কি আর করতে হবে ? চাম্পু অমনি ফট করে পকেট থেকে বের করল একটি দেশলাই ঠোল । বাবুরবাগের চ্যাংড়া-ঠ্যাংড়াগুলো লেখাপড়ায় উন্নতি করুক না করুক, বিড়ি ফুঁকতে সব এক একটা উস্তাদ ।
চারিদিকে শীতের আমেজ । কনকনে ঠান্ডায় আমরা সবাই ঠকঠক করে কাঁপছি আর চাম্পুর অপূর্ব সাদা চকচকে দাঁতদোপাটি কটকট শব্দ করতে লাগল । আর হাসিটা তো একেবারে বাঁধিয়ে রাখার মতো । যাইহোক, এক দুই তিন করে পুরো বারোটা কাঠি নষ্ট করল ব্যাটা । কিন্তু তেরো নম্বরটাই ঠিক জ্বলল । কে বলে আনলাকী থার্টিন ?
আলু পড়ল আগুনের মাচায় । ফটফট শব্দ করে আলু পুড়ছে । সবার জিভে জল আর চোখে আগুনের ছটা পড়ে সেগুলো প্রদীপ্ত শিখার মতো জ্বলজ্বল করছে ।
আমি হাত সেঁকতে ব্যস্ত, আর সানু বারবার পিছনে কি যেন দেখছে । আর আমাদের প্রিয় চাম্পুর তো শুধু এক দিকেয় মন, আরে ভাই আলু পোড়ানোয় । ও বারবার কাঠি দিয়ে নিজের আলু এপিঠ ওপিঠ করে ভালো ভাবে পুড়িয়ে নিচ্ছে ।
বাকিরা গা গরম করছে ।
এইভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল । চাম্পু ভূতের গল্প শুনিয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে । আর আমাদের আলুগুলো যে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সেদিকে আমাদের কোনো খেয়াল নেই । চারিদিক জনশূন্য খাঁ খাঁ করছে । একঘন্টা আগে এখানে গন্ডায় গন্ডায় ছোকরা ছুকরি, চ্যাংড়া চিংড়ি গুলো হৈ হৈ থৈ থৈ করছিল । বুড়িগুলোর ভ্যাকভ্যাকানি আর বুড়োগুলোর খ্যাঁকখ্যাঁকানি কানে কটু বাঁশির মতো বাজছিল । সেগুলো এখন আর নেই । একটু আগে যেমনি ধুমধাম, এখন ঠিক তেমনি শুমশাম । পোকার ডাকে কানগুলো চিঁ চিঁ করছে । আমাদের কথাগুলো ভেসে ভেসে আমাদের কানেই ঢুকছে । তার ওপর আবার প্রচন্ড শীত ।
এমন সময় হঠাৎ পাশেরই বুনো কচুর ঝোপটা সড়সড় করে নড়তে লাগল । হঠাৎ করে এমন হওয়াতে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম । দেখলাম বাকিদেরও একই হাল । সকলে নড়ে চড়ে বসলাম । ঝোপটাতে কি আছে জানার জন্য সবাই ছোটো ছোটো ঢিল মারতে লাগলাম । কিন্তু কোনো ফল হল না । কোনো শব্দই ওখান থেকে উঠে এল না ।
কয়েক মিনিট সবকিছু ঠিকঠাক চলল , যে যার আলু নিয়ে কায়দা করতে লাগলাম মানে অগ্নিকুন্ড থেকে বের করার উপায় করতে লাগলাম । এবার যেই পোড়া আলু গুলো বের করব, ঠিক এমন সময় আবার ঐ একই জায়গা থেকে সড়সড় শব্দ করে কচু পাতা হিলতে লাগল । এইবার কিন্তু চাম্পুর মাথা গরম, খাওয়ার সময় বিরক্ত করলে ও একদম অসূর হয়ে যায় । হল ঠিক সেটাই, মানে অসূর চাম্পু আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না । হাতের মুঠোয় একটা বড় আদলা ইঁট তুলে ছুড়ে দিল ঐ কচুর ঝোপে । তারপর যা ঘটল তা আর মুখে বলা যায় না ।
হঠাৎ একটা কালো মোটা ভোঁদকা শুয়োর গোঁত গোঁত করতে করতে লাফাতে লাফাতে আমাদের দিকে এগোতে লাগল । ভয়ে আমার জানটা শুকিয়ে গেল আর বুকটা ধকধক করতে লাগল । আমি ছিটকে পেছনদিকে পড়লাম । সানু, রাজু আর আকিবেরও একই অবস্থা । কিন্তু চাম্পুর হাল দেখে কে !
"ওরে বাবা রে.. ! ওরে বাবা রে... !"- বলতে বলতে ওর পিছনটা গিয়ে পড়ল একেবারে গরম আঁচের ওপর । ব্যাস্ ! সমস্ত পোড়া আলু চটকে গেল, ধসে গেল । বেশি পিছন-পাকামি করতে গিয়ে চাম্পুর পিছনটা আগুনে ঝলসে গেল ।
আমাদের পোড়াআলু আর খাওয়া হল না । সেদিন থেকে চিরকালের মতো আমাদের আলু পার্টি বন্ধ হয়ে গেল ।। 😆😊😋
Written By-

No comments:
Post a Comment