" পথভোলা "
"আলীম বাবু"
ওর নাম সোমনাথ পাল । ডাক নাম ভোলা, আমি এই নামেই ডাকতাম । আমার সাথে প্রাইমারী স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত সে । তখনকার দিনে আমরা খুব মজা করতাম স্কুলে । টিফিন হলেই কুল পাড়তে, আম পাড়তে, জাম পাড়তে, কাঁঠাল পাড়তে চলে যেতাম ।
এতদিন পরেও সে আমাকে ঠিক চিনে ফেলল । এটা দেখে আমি একটুও অবাক হয়নি কারন ভোলার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, সহজেই কিছু ভুলত না এখনও তাই । কিন্তু আমি প্রথম প্রথম ওকে চিনতেই পারিনি । পরে যখন পরিচয় দিল তখন চিনতে পারলাম । আমার চেহারায় খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও ওর চেহারাটা অনেকটা পাল্টে গেছে ।
কেমন যেন চোখদুটো অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেছে, চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে । গায়ে ময়লা বসে গেছে । যেন প্রায় সপ্তাহখানেক স্নান করেনি । মুখটা আগের থেকে অনেক বেশি কালো মনে হল । এত কালো তো সে আগে ছিল না । দিনের পর দিন রোদে রোদে ঘুরলে ফর্সা মানুষের মুখখানা যেমন কালো দেখায় ঠিক তেমন ।
আমি বললাম, ভালো আছি । তারপর আমিই বলে উঠলাম, " তুই কেমন আছিস । অনেক দিন পর তোর সাথে দেখা হল । তোর এই অবস্থা কেন রে ভাই । তোর কি হয়েছে ?
সে বলল, " আমি বিয়ে করেছি । আমার একটা মেয়ে হয়েছে ও এখন ছমাসের শিশু । "
আমি বললাম, " এ তো ভালো খবর ।"
ভোলা বলল, " না রে ভাই, ভালো খবর না ।"
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, " কেন এমন বলছিস, মেয়ে হয়েছে বলে ?"
ভোলা বলল, " না রে ভাই ! আমার মেয়েটি ভারী অসুস্থ । ওর একটা অপারেশন করাতে হবে । পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হবে । কিন্তু আমার কাছে পঁচিশটা টাকাও নেই ।"
ভোলার কথা শুনে ভারী কষ্ট হল । চোখদুটো প্রায় জলে ভরে এল ।
ভোলা বলল, " আমার চাকরিটা চলে গেছে রে । একটা বেকারীতে কাজ করতাম । রুটি কেক বানাতাম । ভালোই চলছিল কিন্তু ঐ নতুন ম্যানেজারটা আসার পর সবকিছু কেমন শেষ হয়ে গেল রে ভাই !"
আমি বললাম, " ম্যানেজার কি করল ?"
ভোলা বলল, " ওই ম্যানেজারের সাথে আমার বনিবনা হত না । একদিন চুরির অপবাদ দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিল । "
আর আমার বাবাও আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । সম্পত্তি থেকে বেদখল করেছে ।
তাদের কাছে হাত পাতেনি ভাই ! "
আমি বললাম, " বেদখল করল কেন ? "
ভোলা বলল, "প্রেম করে বিয়ে করেছি বলে । তোদের জাতের মেয়ে বলে ঘরে তোলেনি বরং ঘরছাড়া করে দিল ।"
আমি কিছু না বলে চুপ করে ওর কথাগুলো শুনে গেলাম ।
ভোলা বলল, "ভাই তুই আমাকে টাকাটা ধার দিতে পারবি । আমি খুব শীঘ্রই শোধ করে দেব । কথা দিচ্ছি ।"
আমি ভাবুক হয়ে পড়লাম । ভোলাকে কি করে বলি যে আমার চাকরিটাও চলে গেছে । অবশ্য চুরির অপবাদে নয়, আমার অ্যাটিটিউডের কারনে আমার জেদের কারনে ।
যাই হোক আমি এসব কথা ভোলাকে বললাম না । বেচারা একেই দুঃখী, তারওপর আমার দুঃখ ওকে শোনাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই । তাছাড়া আমার পকেটে মাত্র দুশো টাকা পড়ে আছে । কিন্তু ভোলার দরকার পঁচিশ হাজার টাকা। তাই দুশো টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমি ওর অপমান করতে চায় না । আমার কাছে অতগুলো টাকা থাকলে এমনিতেই আমার বন্ধুটিকে দিয়ে দিতাম । কিন্তু আমিও যে অসহায়, আমিও যে বেকার সেকথা ওকে বলি কি করে ।
অবশ্য আমি এখনও বিয়ে করিনি তাই সংসারের চাপ এখনও ঘাড়ে আসেনি ।
চোখের জল মুছে দেখলাম ভোলা কিছুটা দূরে আরও দুটো লোকের সাথে কথা বলছে । তাদের দুজনায় মাঝ বয়স্ক লোক । বোধহয় ভোলা ওদের কাছে টাকা ধার চাইছে । হঠাৎ দেখলাম ওদের মধ্যে একজন ভোলাকে ধাক্কা দিল । আর একটু হলেই ভোলা মাঝ রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ত কিন্তু কোনো রকম নিজেকে সামলে নিল ।
বড্ড বেয়াদপ লোক তো ! সাহায্য চাইলে ওভাবে কাওকে ঠেলে দেয় নাকি ! পারবো না অথবা দেবো না বলে দিলেই তো হয় !
লোকটার উপর ভীষণ রাগ হল । ইচ্ছে করল লোকটাকেও ঠিলে রাস্তায় ফেলে দিই, কেমন লাগে বুঝুক ব্যাটা !
কিন্তু ভাবলাম, না থাক্ গে, ও নিষ্ঠুর বলে কি আমাকেও অমন হতে হবে নাকি ।
রেগে রেগে লোকটার দিকেই তাকিয়েছিলাম । কখন যে ভোলা চলে গিয়েছে বুঝতেই পারলাম না ।
ওই লোক দুটো আমার দিকেই আসছে দেখে কেন জানি না আমার রাগটা আরোও বেড়ে গেল ।
তারপর লোক দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করতে লাগল ।
আমি ঐ লোকটার কথাগুলো পরিস্কার শুনতে পেলাম ।
সেই লোকটা অপরজনাকে বলছে,
" নেশা করে পুরো দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গল !
জোয়ান জোয়ান ছেলেগুলো সব মদ-গ্যাঞ্জা-ড্রাগস্ খেয়ে খেয়ে শরীরের আর কিছু রাখল না " ।।
No comments:
Post a Comment