"দ্য জ্যেন্টলম্যান"
"আলীম খান"
একটি বাস স্টপেজে তখনও কোনো লোক ছিলনা কিন্তু হঠাৎ সেখানে একজন বুড়োলোক এসে হাজির হল । একেই বয়সের দোষ তারওপর গরমের মারে সে প্রায় নাজেহাল হয়ে পড়েছে । একটু বিশ্রামের একান্তই প্রয়োজন ।
তাই সে স্টপেজের পরিস্কার ঝকঝকে তকতকে সাফসুধরা বসার সীটে বসে একটু জিরিয়ে নিতে চাইল ।
কোনো বাসের আশায় তার মাথা ব্যথা নেই । পেশায় সে একজন ভিখারী, সকাল থেকে ভিক্ষা করে করে দুচার পয়সা উপার্জনও করেছে সে । হেঁটে হেঁটে পায়ে খুব ব্যথা ধরেছে ।
প্রচন্ড ক্লান্তি তাকে ঝাঁকিয়ে ধরেছিল, তাই একটু জিরিয়ে নিতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা সে নিজেই বুঝতে পারল না ।
হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল একটা শোরগোলের আওয়াজে । যেন তার একেবারে কানের কাছে কেউ বকবক করছে ।
চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই সে দেখল দুজন আগন্তুক স্টপেজে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে আর মাঝেমধ্যে হো হো করে হাসছে ।
এতক্ষণ সে হাত পা ঝোলাটোলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়েছিল । কিন্তু অন্যদের আগমনে সে বেশ সচেতন হল, পোটলাপুটলি সমেত হাত পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল ।
সে লক্ষ্য করল আগন্তুক ব্যক্তিরা শ্যুটবুট পরিহিত আর তাদের পাশে রাখা রয়েছে দামী লেদারের ব্যাগ ।
বুড়োলোকটা ধারণা করল যে ঐ দুজন ভদ্দলোক কোনো অফিসটফিসের চাকুরেজীবি হবে হয়ত ।
আসলে তারা দুজনায় একই বি.ডি.ও. অফিসের কর্মী ।
তেরো বছরর পরিচিতি রয়েছে তাদের । কয়েক বছর একসাথে কাজ করার ফলে তাদের সম্পর্কটাও বেশ মধুর এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । তাই পাশাপাশিই বাসা করেছেন বছরখানেক আগে ।
এমনকি তারা অফিস যান একই বাসে আর অফিস ছুটির পর একসাথেই বাসায় ফেরেন ।
স্টপেজে বসে দুই ভদ্দলোক গল্পগুজব করতে লাগল । সময়ের বাসটি মিস করেছেন তারা এবং পরের বাসটি আসতে প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট দেরি ।
তাছাড়া আজ তাদের মোটেও তাড়া নেই । কারণ অফিসের বার্ষিকী দিবসে আজ ভালোই আনন্দ উপভোগ করেছেন, কাজটাজ কিছুই করতে হয়নি । তাছাড়া খাওয়া দাওয়াও হয়েছে খুব ।
তবুও অফিসবয় তাদের হাতে একটি করে খাবারের প্যাকেট থামিয়ে দিয়েছে ।
প্যাকেটগুলো হাতে রেখে তারা পরের বাসটির জন্য অপেক্ষায় বসে রইলেন । অবসর দেখে তারা নানান জাতের গালগল্পে মেতে গেলেন ।
দেশের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির কড়া চর্চা, নির্লজ্জ রাজনীতির দাম্ভিক সমালোচনা প্রভৃতি তাদের গল্পের মূল বিষয়বস্তু তবে তর্কবিতর্ক নেই বললেই চলে ।
পাশেই বসে সেই বুড়োটা বাবুদের এসব আলোচনাগুলো শুনতে লাগল, কিছুটা বুঝতে পারল আর কিছুটা এক কানে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেল ।
তারা ঠিক করল যে এইভাবে প্যাকেটখানা হাতে করে বাড়ি না নিয়ে গিয়ে বরং এখানেই খেয়ে নেবেন । আর এমনিতেও পেট ভরেই আছে তবুও প্যাকেটগুলো বয়ে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয়না ।
তারা প্যাকেট খুলে দেখল তাতে রয়েছে রাধাবল্লভী, সীতাভোগ, দই, মিস্টিগজা আর সন্দেশ ।
দুপুর পার হতে হতেই বুড়োর মনে পড়ল তার দুপুরের খাওয়াটা এখনি সেড়ে নেওয়া দরকার । অবশ্য বাবুদের হাতে খাবারের প্যাকেট দেখেই তার টনক নড়েছিল । প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার । তাই পায়ের কাছে রাখা ধুলোময় নোংরা থলে থেকে চটজলদি খাবারের টিফিনটা বের করে নিল । টিফিনে কেবল দুখানা পোড়া রুটি আর একটুখানি বাসি আলুভাজি রয়েছে, এটাই তার কাছে যথেষ্ট । বুড়ো মানুষের পেট, কত আর খাবে !
ঠিক তখনই দুই ভদ্দলোক তার দিকে বাঁকা চোখে তাকালো কিন্তু বুড়োটা তা লক্ষ্য করল না । ভিখারিকে টিফিন হাতে দেখে বাবুদের একজন মুখখানা এমনভাবে বিকৃত করল যেন কোনো বন্য পশু অথবা কোনো ঘৃণ্য প্রাণীর দর্শন করেছেন ।
এতক্ষণ পাশেই বসে থাকা ভিখারিটিকে অসুবিধের বস্তু বলে তাদের মনে হয়নি কিন্তু এখন কেমন যেন সেই ভিখারি বুড়োটা তাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল ।
তারা পরস্পরের মধ্যে মিহি গলায় কিসব বলাবলি করতে লাগল তা বুড়োটা শুনতে পেল ঠিকই তবে বুঝে উঠতে পারল না ।
বাবুদের খাবারের প্যাকেট উধম হয়ে রইল কিন্তু সেই খাবার আর বাবুদের মুখ পর্যন্ত গেল না ।
একজন নোংরা অসভ্য ভিখারীর সাথে এক জায়গায় প্রায় পাশাপাশি বসে লাঞ্চ করবে ! এই ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকল তাদের কাছে ।
তারা সভ্য সমাজের শিক্ষিত মার্জিত ব্যক্তি আর ওরা কিনা একজন অসভ্য ভিখারির সাথে বসে লাঞ্চ করবে !
এটা তো ব্যাপক অপমানজনক বিষয় ! বন্ধুস্থানীয় কেউ দেখলে কি ভাববে !
এতো খুব লজ্জার বিষয় ।
বাবুরা ঠিক করল ভিখারীকে স্টপেজ থেকে বিদেয় করবে ।
সুতরাং ততক্ষণাৎ একজন ভদ্দলোক দাঁত খিচিয়ে ভিখারীর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল,
" এই যাও এখান থেকে ! যতসব !
পরিস্কার সাফ জায়গাটাকেও নোংরা করবে দেখছি ।!
এদের জ্বালায় কোনো জায়গা সাফ রইবে না !
সারা দেশটাকে নোংরা করে ছাড়লে !
যাও এখান থেকে ! যাও বলছি !
যাও ! "
ভিখারী বুড়োটা বুঝল বাবুরা কোনো এক অজানা কারণে তার উপর ভীষন রকমের চটে আছেন । কিন্তু কারণটা বুঝতে পারল না ।
বুড়ো খানিক ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তড়িঘড়ি তার টিফিন আর পোটলাপুটলি নিয়ে বাসস্টপেজ থেকে নেমে এল । তারপর হাতখানেক দূরে একটি বকুল গাছের ছাওয়ায় বসে পড়ল ।
বুড়ো কেটে পড়াতে বাবুরা যেন তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মসম্মান ফিরে পেলেন । এইবার খাওয়াটা সেড়ে ফেলা যেতে পারে ।
বাবুরা তাদের খাওয়া যেই শুরু করতে যাবে, ঠিক এমন সময় কোত্থেকে এক নেড়ি কুকুর এসে পৌঁছল ওই বাস স্টপেজে ।
আর এসেই ঠিক বাবুদের পায়ের কাছে বসে পড়ল ।
কুকুরের মুখ থেকে লালা ঝড়তে লাগল বাবুদেরকে খেতে দেখে । যদি বাবুরা কিছুটা দেয় ।
কুকুরের শরীরের অবস্থা একেবারে জীর্ণশীর্ণ, যেন কত কাল পেট ভরে খেতে পাইনি এই অবলা জীবটি ।
বাবুদের কাছে বসে কুকুরটি কুঁই কুঁই করতে লাগল । বোধহয় ভিক্ষা চাইল । কিন্তু কুকুর তো আর মানুষের মতো কথা বলতে পারেনা তাই বাবুদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ।
কুকুরটি একটুখানি উচ্ছিষ্টের আশায় ওত পেতে তীর্থের কাকের মতো বসে রইল । কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত দুই বাবুদের কেউই কুকুরের ভাষা বুঝতে পারল না ।
আর তাছাড়া গরু ছাগল বেড়াল কুকুরের ভাষা বোঝা সভ্য মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত নয় । কুকুরের উপস্থিতি বাবুদের বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়াল ।
একজন বাবু 'হেঁই হেঁই ছেঁই ছেঁই' করে কুকুরটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করল । কিন্তু কুকুরটি তার জায়গা থেকে নড়েও না সড়েও না !
তাই সেই ভদ্রলোক একটু কোমরচাড়া দিয়ে কুকুরটিকে লাথি মারার উপক্রম করল
আর তাতেই তিনি সফলতা পেলেন ।
একেই গায়ে কিছু নাই তারওপর মার খাওয়ার ভয়ে কুকুরটি কোনোরকম আওয়াজ না করেই সড়াৎ করে সড়ে পড়ল এবং সোজা ভিখারি বুড়োটার কাছে গিয়ে বসে পড়ল ঠিক আগের মতো ।
বুড়োও দুইতিনবার তাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে হাল ছেড়ে দিল । ইতিমধ্যে একখানা রুটি বুড়োর পেটে গেছে । দ্বিতীয়টা খেতে যাবে ঠিক এমন সময় বুড়োটা করুণ দৃষ্টিতে প্রাণীটির দিকে
তাকিয়ে রইল । কুকুরের দেহের চরম অবনতি দেখে সে মর্মাহত হয়ে পড়ল ।
তাই সে তার রুটির আধেকটা আর খানিক আলুভাজি কুকুরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, " এই নে খা । "
খাবার দেওয়ামাত্র মুহুর্তে শত্বরে তা কুকুরের উদরে পৌঁছে গেল ।
ঠিক তখনই বাস স্টপেজের কাছ থেকে ধপ করে কি একটা শব্দ হল । বুড়োটা দেখল বাবুরা উঠে দাঁড়িয়েছেন, বোধহয় যাবার জন্য তৈরি বাবুরা ।
দূর থেকে বাসের হর্ন বাজার শব্দ শোনা যেতে লাগল । হঠাৎ কুকুরটা উঠে দাঁড়িয়ে সোজা স্টপেজের দিকে ছুটল ।
ভিখারি বুড়োটা গাছের ছাওয়ায় বসে দেখল বাবুরা বাসে চেপে চলে গেলেন । আর এদিকে কুকুরটি ঝাঁপিয়ে পড়ল স্টপেজ সংলগ্ন ড্রেনটাই ।
আসলে বাবুরা যা খেতে পারেননি তা বাস স্টপেজ সংলগ্ন ড্রেনটাই ফেলে দিয়ে গেছে ।।
No comments:
Post a Comment