"ডাস্টবিন"
" আলীম খান "
অনেকদিন ধরেই চাকরির জন্য এদিক ওদিক অনেক ঘোরা ঘুরি করেছে কিন্তু কোথায় তার মনের মতো একটা ভালো কাজের সন্ধান সে পায়নি । যে কাজটা সে পেয়েছিল সেটা মোটেও তার মনে ধরেনি । মার্কেটিংএর একটা কাজ কয়েক মাস করেছিল হাসান । কাজটা তার ভালো লাগত না । কাজটা একটা বিরক্তকর বিষয় হয়ে উঠেছিল ।
ধীরে ধীরে সে মেন্টালি স্ট্রেসের শিকার হয়ে পড়ে ছিল । আর কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলে সে নিশ্চিত মানসিক রোগীতে পরিণত হত । শরীরখানা প্রায় ভেঙে পড়েছিল তার । ছেলের শোচনীয় অবস্থা তার মায়ে চোখে ঠেকতে একটু দেরি হয় বটে তবে শেষমেষ মায়ের চাপে হাসান কাজটা ছেড়েই দেয় । এই কাজটা যে একেবারে অসহ্য সে কথা হাসান একটি বারের জন্যও বাড়িতে জানায়নি ।
তবে এখন যে কাজটা সে পেয়েছে সেটা তার খুব পছন্দের । এখন সে এক প্রখ্যাত রাইসমিল 'মা লক্ষ্মী রাইসমিল' এর অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট । সহায়কের চাকরিটা হাসানের খুব মনোপুত হয়েছে । এই রকমের কাজই তো সে চেয়েছিল । কাজের প্রতি ভালোবাসা ও টান তাকে রোজ সকাল সকাল অফিসে টেনে নিয়ে আসে । সব কাজই আগ্রহের সাথে করে সে ।
আজ ম্যানেজার অসীমবাবু একটা কাজ দিয়েছেন । হাতে একখানা পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক্ দিয়ে বললেন ব্যাঙ্কে গিয়ে এনক্যাস করিয়ে আনতে । হাসান দেড়ি করল না, ব্যাগ নিয়ে সটান রাস্তায় নেমে এল । এস.বি.আই. ব্যাঙ্কটা খুব বেশি দূরে নেই ; অফিস থেকে মাত্র তিন-চার মিনিটের হাঁটা পথ । তাই হেঁটে যাওয়াটাই হাসানের কাছে বেটার মনে হল। আর তাছাড়া হাঁটা তো স্বাস্থের পক্ষে ভালোই ।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সামনেই শিবুদার চায়ের দোকানের দিকে নজর গেল হাসানের । একটু চা খেলে ভালোই হয় !
সকালে চা না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিল । তার মা ব্যাগের মধ্যে দুটো কলা আর একটা কেক ভরে দিয়েছেন । অফিসে গিয়েই খেয়ে নিতে বলেছেন । হাসান ভাবল চায়ের দোকানেই না হয় টিফিনটা করে নেবে আর একটা চা খেয়ে নেবে । ব্যস্ তাইলেই হবে । তাই হাসান শিবুদার চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়াতে লাগল ।
ধীর কদমে হাঁটছিল হাসান ঠিক এমন সময় কি একটা কালোমতো জিনিস ধপ্ করে উপর থেকে তার পায়ের কাছে পড়ল । প্রথমে তো সে চমকেই উঠেছিল কিন্তু যখন সে জিনিসটার দিকে তাকালো আর বুঝল যে এটা তো একটা পলিথিন ব্যাগ মাত্র, তখন খানিকটা স্বস্তি পেল । সে দেখল, পলিথিন ব্যাগে ঠেঁসে ঠেঁসে ভরা রয়েছে নোংরা আর্বজনা ।
হাসান তৎক্ষণাৎ উপরে ছাদটার দিকে তাকাল এবং এক ভদ্রমহিলাকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল, সে মহিলাটি তাকেই দেখছিল । হাসান বিরক্তিস্বরে বলে উঠল, "এই যে দিদি ! বাড়ির আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলতে হয় । এইভাবে যেখানে সেখানে ফেলে দিয়ে নোংরা করছেন কেন ?"
হাসানের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না ভদ্রমহিলা । তবে মুখখানা একটু বিকৃত বিড়বিড় করে কিসব বলে ভদ্রমহিলা কেটে পড়ল । হাসান বুঝল, তার এই উপদেশ ভদ্রমহিলার মোটেই পছন্দ হয়নি । আসলে একটুর জন্য বেঁচে গেছে হাসান, তা নাহলে সেই আর্বজনা ভরা পলিথিন ব্যাগটা একেবারে তার মাথাতেই পড়ত । যাক ভাগ্য ভালো !
শহরের রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা কিরকম তা আর কাওকে বুঝিয়ে বলতে হবে না । হকাররা তাদের দোকানপাঠ নিয়ে যেভাবে রাস্তায় বসে পড়ে তাতে রাস্তার তিনভাগের একভাগই মাত্র যাতায়াতের উপযুক্ত থেকে যায় । শুধু কি যাতায়াতের অসুবিধা ! আছে নানারকমের দূষন । আবার শব্দদূষন তো আরও এক ভয়ঙ্কর সংকট । মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ যেন যানবাহন এবং কলকারখানার শব্দের মাত্রাকেও হার মানায় । রাস্তার চারধারে যেখানে সেখানে শুধু আর্বজনা আর নোংরায় ভরা । যদিও ডাস্টবিনের কমতি নেই তাসত্ত্বেও আর্বজনাগুলো ডাস্টবিন পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে
ফেলে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও আজ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে বোধহয় । সরকারের সচেতনতা থাকলেও পাবলিকের মধ্যে তা কতটুকুই বা আছে ! এইসব উদ্ভট চিন্তাগুলো হাসানের মাথার চতুর্দিকে ঘুরঘুর করতে লাগল ।
শিবুদার চা'র দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে পাশেই দেবদারু গাছেটার ছাওয়ায় বসে পড়ল হাসান ।
তার হাতখানেক দূরে একজন মাঝবয়সি বেঁটে মতন লোক "গরম গরম চানাচুর ভাঁজা" বলে হকারি করছিল ।
- "গরম গরম চানাচুর ভাজা, খেতে মজা ! "
কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখে হাসান তা থেকে একটা নোটবুক বের করল । তারপর নোটবুকের পাতা উল্টে পাল্টে কিছু একটা লেখা খুঁজতে লাগল কোনো দরকারি লেখাটেখা হবে হয়ত । এই নোটবুকের পাতার মাঝে সে চেকটা রেখেছে । সিগনেচারটা করে নিলে কেমন হয় ! হাসান চেকটা বের করে তাতে খুব সুন্দর করে নিজের সইটা করে ফেলল । তারপর আবার চেকটা নোটবুকে রেখে দিল । কিন্তু হঠাৎ আচমকা চেকটা নোটবুক থেকে বেরিয়ে গেল, বেরিয়ে এসে বাতাসের টানে ঘুরপাক খেতে খেতে রাস্তায় পড়ল । ওভাবেই চেকটা কিছুক্ষণ পরে ছিল কিন্তু হঠাৎ সোঁ সোঁ করে দুখানা অ্যাম্বুলেন্স পেরিয়ে যাওয়ায় আর তা থেকে উৎপন্ন দমকা হাওয়ায় চেকটা উড়ে গিয়ে হকারের ঠিক ডানপাশে
বড়ো চোঙাকৃতি টিনের ডিব্বাটার কাছে পড়ে রইল । চেকটা যে স্হানচ্যুত হয়েছে সেদিকে কিন্তু হাসানের কোনো খেয়ালই রইল না । সে তার লেখাটা খুঁজতেই ব্যস্ত । অবশ্য এক দেড় মিনিটের মধ্যে প্রয়োজনীয় লেখাটা খুঁজে পেল এবং গভীর মনোযোগ সহকারে লেখাটা পড়তে লাগল ।
পড়তে পড়তে হাসান একটু বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিল । তারপর সেই খামখেয়ালি মনে আশেপাশের দৃশ্যগুলিকে দৃশ্যস্থ করতে লাগল । হাসান দেখল, রাস্তার ওপারটাই একটা ছেলে হকারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । বোধহয় ওর চানাচুর ভাজা খেতে খুব ইচ্ছে করছে । এক ভদ্রমহিলা একটি শিশুর হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল কিন্তু কি একটা কারনে হঠাৎ একেবারে হকারের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল । তারপর সেলফোনে কারও সাথে কথা বলতে লাগল আর শিশুটি তখন একভাবে হকারের চানাচুরের ডিব্বাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । হকারের হাঁকডাকের কলাকৌশল শিশুটির মনে হয়ত চানাচুরভাঁজা খাওয়ার লালসাকে বাড়িয়ে দিল । আলতো চোখে শিশুর লালসাময় মুখাবয়বের সূক্ষ ধাঁচকে আঁচ করে নিতে হকারে বোধহয় এক সেকেন্ডও সময় লাগালো না, যেন এই কলাগুণ বংশ পরম্পরায় বজায় রয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র ঘূণ ধরেনি । তাই হকার আরও জোরে জোরে আশ্চর্য্য কলাকৌশলে সুন্দর করে শ্লোগান দিতে লাগল ।
- "গরম গরম চানাচুর ভাজা, খেতে মজা ! "
চানাচুর খাওয়ার জন্য শিশুটি তার মায়ের কাছে আবদার করতে লাগল কিন্তু ওর মা এমনভাবে চোখপাকিয়ে শাষানি দিল তাতে শিশুর চানাচুর খাওয়ার লোভ নিমেষেই ঘুঁচে গেল । শিশুর ছোট্ট গোলপারা মুখটা আরো ছোট হয়ে গেল । শিশুটির ঐ উদাসীন মুখটা হাসানকে খানিক উদাস করলেও হাসানের ঠোঁটের গোড়ায় খানিক মৃদু হাসি ঝলকে উঠল ।
শিশু ও তার মা চলে যাওয়ার পর হাসানের দৃষ্টি দৃঢ়ভাবে এবার রাস্তার ওপারের ছেলেটার দিকে । সে একবার ঐ ছেলেটার দিকে তাকায় আর একবার নোটবুকের বিশেষ লেখাটার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে বিড়বিড় করে পড়ে । তারপর নোটবুক পড়তে পড়তে লেখার মায়াবি ঘুলঘুলিয়ার মধ্যে কখন যেন সে হারিয়ে গেল । তার খেয়ালই নেই যে তার চেকটি নোটবুক থেকে সড়ে পড়েছে ।
ছেলেটা কখন যে হকারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা হাসান এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি কিন্তু যখন ছেলেটি অদ্ভূত ভাষায় কিছু বলতে লাগল তখন হাসানের নজর গেল ছেলেটার উপর । এটা আসলে কোনো বিশেষ ভাষা নয়, বলা যেতে পারে বোবাদের ভাষা । আসলে ছেলেটা বোবা ।
হাবাবোবা ছেলেটা তার কায়দায় দুটাকার চানাচুর অর্ডার করল । হকার বোধহয় বুঝতে পারল কিন্তু হকার পরিস্কার জানিয়ে দিল যে পাঁচ টাকা ছাড়া হবে না । ছেলেটা কাকুতিমিনতি করতে লাগল, সে নাছোড়বান্দা । লোকটা প্রথম প্রথম না না করতে লাগল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোমতে রাজি হল । তারপর লোকটা এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে দেখল । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাতের কায়দায় ছেলেটাকে দাঁড়াতে বলল । হকার মিক্সচার বানাতে লাগল । তারপর ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকাকালীন লোকটা টুক্ করে পাশে পড়ে থাকা কাগজটা হাতে তুলে নিল । কাগজটা মানে হাসানের চেকটা । তারপর সেটিকে হস্তশিল্প কারুকার্যের দ্বারা ঠোঙায় পরিবর্তিত করল ।
কিন্তু তার চেকটির যে এই দুর্দশা হচ্ছে তা হাসান বুঝতেও পারল না । গরম গরম চানাচুর মিক্চার ঠোঙাময় চ্যেকের মধ্য দিয়ে বোবা ছেলেটার কাছে হস্তান্তরিত হল । ছেলেটা হাসানের গজদুই দূরে বসে চানাচুর খেতে লাগল ।
হঠাৎ অন্যমনস্কতা ভেঙে গেল হাসানের । চেকটি সঠিক জায়গায় আছে কিনা তা দেখার জন্য পাতা উল্টোতেই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল । কারণ চেকটি তার স্বজায়গায় নেই, হাপিস্ হয়ে গেছে । নোটবুকের প্রত্যেকটা পাতা পাল্টে পাল্টে দেখতে লাগল কিন্তু চেকটি খুঁজে পেল না । বোধহয় ব্যাগের ভিতরে পড়ে গেছে এইভেবে ব্যাগটি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল সে । কিন্তু না, ব্যাগের ভিতর চেক নেই । বাকি সব কিছু যথাস্থানেই রয়েছে কেবল ওই চেকটিই নেই । এসব কখন হল, কি করে হল, কিভাবে হল - তা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না সে । প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে উঠল হাসানের ।
এদিকে গরম চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আগে দরকারি জিনিষটা খুঁজে পাওয়া দরকার । হাসান তার আশেপাশে সব জায়গায় খুঁজে দেখল । হঠাৎ হাসান হকারের দিকে তাকাল আর তখন হকারও স্থির হয়ে অস্থির হাসানকেই দেখছিল ।
হাসান হকারটিকে জিজ্ঞেস করল, "আপনি একটি এরকম সাইজের কাগজ দেখেছেন " - এই বলে হাতের ভঙ্গিতে চেকটির আকারপ্রকার ইঙ্গিত করে দেখাল ।
হাতের কায়দায় হাসান চেকটির মাপ দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু হকার সবটা বুঝেও কিছু না বোঝার বাহানা করতে লাগল । চেকটি পরিণতি কি হয়েছে তা হকারের ভালোভাবেই জানা । হকার খানিক আশঙ্কিত হয়ে পড়ল তারপর হাবাবোবা ছেলেটির দিকে অর্থাৎ তার হাতের ঠোঙাটার দিকে একভাবে দেখতে লাগল । সে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল । হকারের কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে হাসান ঐ বোবা ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেল ।
হাসান জিজ্ঞেস করল - " ভাই, একটা কাগজ দেখেছ । ঠিক এরকম সাইজের" , এই বলে হাসান হাত দিয়ে কাগজের সাইজটা বোঝাতে লাগল । কিন্তু ছেলেটা অদ্ভুদভাবে হাসানকে দেখতে লাগল । হাসান স্পষ্ট বুঝতে পারল যে ছেলেটা শুধু বোবাই নয়, কালাও বটে । তাই হাসান তাকে ঈশারায় ঈঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করল । কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই উল্টো হয়ে গেল । মানে ছেলে উল্টো বুঝল । ছেলেটা ভাবলো হাসান তাকে শাষানি দিচ্ছে । প্রথমে কিছুক্ষণ শঙ্কিত মনে সে হাসানের দিকে তাকিয়ে থাকল । তারপর রেগে গিয়ে খালি ঠোঙাটাকে হাতে করে দুমড়ে মুচড়ে সেটা দিয়ে হাসানের দিকে ছুড়ে মারল । ছেলেটার এইরকম ব্যবহারে হাসান একটুও রাগ করল না ।
বরং শান্তভাবে হাসিমুখে আঙুল দিয়ে ঈশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, নোংরা কাগজটাকে ঐ যে ডাস্টবিনটা রাখা রয়েছে সেখানে ফেলে আসতে । হাসান অবাক হল, কারন ছেলেটা তার ঈশারা বুঝেছে । ছেলেটা নোংরা কাগজটাকে হাতে তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল । হাসান হাসি মুখে ছেলেটার দিকে তাকাল কিন্তু বিড়বিড় করে কিসব বলে পাশের গলিটাতে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
এইভাবে প্রায় দুআড়াই ঘন্টা কেটে গেল । অফিসে কি মুখ নিয়ে ঢুকবে সে । আজ লাপরোয়ার তকমা তার কপালে লেখা রয়েছে । মাত্র কয়েকদিন হল চাকরিটাই জয়েন করেছে আর এর মধ্যেই এরকম একটা খামখেয়ালীপনা কি ম্যানেজারবাবু সহ্য করবেন ? নাকি আজ হাসানের চাকরিটা যাবে ? এইসব ভাবতে ভাবতে একরকম বিষন্নতা তাকে আঁকড়ে ধরল । গরম চা ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ । মাটির ভাড়ের চা ভাড়েতেই রয়ে গেল । হকার অনেকক্ষণ হল কেটে পড়েছে । হাবাবোবা ছেলেটিও চলে গেছে । মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকল হাসান ।
সকাল কখন কালের নিয়মে পেরিয়ে গেছে । এখন দুপুর । চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ আগেই ঝাঁপ পড়েছে । উক্ত স্থানে কেবল হাসান বসে বসে বিলাপ করতে লাগল । প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছে সে তবুও স্থান ত্যাগ করেনি । এদিকে তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে পেটের ভিতর থেকে চুঁ চুঁ শব্দ করে কেউ ডাকছে । যা হওয়ার তা হয়ে গেছে । আর আক্ষেপ করেই বা কি হবে । বরং খেয়ে নেওয়া যাক । ব্যাগের মধ্যে দুটো কলা আর একটি কেক রয়েছে, তা এখনও খাওয়া হয়ে উঠেনি ।
দেখতে দেখতে আরও অনেকটা সময় কেটে গেল । হাসানের মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । পঞ্চাশ হাজার টাকার চ্যেক এনক্যাশ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ম্যানেজারবাবু ।
কয়েকদিনেই স্যারের খুব ভরসা অর্জন করেছিল হাসান । কিন্তু আজকের পর আর তাকে ভরসা করবেন কিনা তা জানে না । নাই বা হল নগদ টাকা কেবল একখানা কাগজ মাত্র তবুও চেকখানা কেবলমাত্র একটা কাগজ ছিল না । সেটা ছিল একটা বিশ্বাস, তার কাজ এবং দায়িত্বের একটি নিরবিচ্ছিন্ন অংশ । যেই দায়িত্ব পালনে আজ হাসান ব্যর্থ হয়েছে ।
ঘেমে শার্ট পুরো ভিজে গেছে । খিদের জ্বালায় পেটে অসহ্য ব্যথা অনুভূত হতে লাগল । আর থেমে থাকতে পারল না হাসান । আগে কেকটা খেয়ে তারপর গবগব করে কলাদুটো খেয়ে ফেলল । আর কলার খোসাগুলো রাগে রাস্তায় মাঝে ছুড়ে দিল । হতাশাগ্রস্ত হয়ে আবার কিছুক্ষণ এদিক ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগল । কিছু একটা মানে অবশ্যি চেক'টাই খুঁজতে লাগল । কিন্তু আবার সে বিফল হল । অনেক হয়েছে আর নয় , ভেবে হাসান স্থির করল এবার সে অফিসে যাবে । পুরো ঘটনাটা খুলে বলবে ম্যানেজারবাবুকে । তারপর যা হবে দেখা যাবে ।
আপিসে যাওয়ার উপক্রম করে সে দুইচার পা এগিয়ে আবার থেমে গেল । পিছন ফিরে রাস্তায় পড়ে থাকা কলার খোসাগুলো দেখতে লাগল । হাসানই সেগুলোকে একেবারে রাস্তার মধ্যেখানে ফেলে রেখেছে । কিন্তু এইভাবে কলার খোসা রাস্তায় ফেলে রাখা ঠিক নয় । যেকোনো সময় বড়োসড়ো বিপদ হয়ে যেতে পারে ।
এটা কি সে ঠিক করল ? এতে কি তার মানবিকতা তাকে ধিক্কার দেবে না ?
সে নিজেকে দেশের একজন আদর্শ নাগরিক মনে করে ।
আর সেই যদি এইধরনের অনৈতিক কাজ করে তাহলে কি করে সে তার নীতি আদর্শ বজায় রাখবে ?
এই রকমের অস্বচ্ছতা তার বুকের ভিতর আঁচড় কাটবে না ?
সমাজের আর পাঁচটা নির্লজ্জ মানুষদের লিস্টে সেও কি নাম লেখাবে ?
কয়েক গজ দূরে চা'র দোকানের গায়ে ডাস্টবিনটা রয়েছে । তাতে কিছু একটা লেখা আছে ইংরেজি ভাষায়, হাসান সেটা পড়ল ।
-USE ME.


No comments:
Post a Comment