Wikipedia
Search results
Pageviews
নিচের follow button টির দ্বারা আপনি এই ওয়েবসাইট টি follow করতে পারেন ।
Thursday, 20 August 2020
Home
/
কিশোর সাহিত্য
/
চাম্পুর কালাজাদু / চাম্পু অ্যাডভেঞ্চারস্ সিরিজের গল্প / হাসি-মজার গল্প / কিশোরদের গল্প / ছোটোদের গল্প
চাম্পুর কালাজাদু / চাম্পু অ্যাডভেঞ্চারস্ সিরিজের গল্প / হাসি-মজার গল্প / কিশোরদের গল্প / ছোটোদের গল্প
খেলার মাঠ থেকে সবে এইমাত্র বাসায় ফিরেছি । ফিরতেই হাতমুখ দুয়ে চটপট পড়তে বসে গেলাম । স্যারের ব্যাচে কাল অঙ্ক পরিক্ষা । তিনখানা উপপাদ্য নিয়ে লেগে পড়েছি কিন্তু অনেকক্ষণ লড়াই করার পরও যখন একখানাও মাথায় ঢুকল না তখন একবার ভাবলাম নকল করে রাখি পরিক্ষার সময় টুকলি করে নেবো । কিন্তু পরমুহুর্তেই স্যারের রামগাঁট্টার কথা মনে পড়ে গেল । তাই নকল করার আর সাহস হল না ।
সেই একবার 'বুদু চিরকানি' কেসটায় রামগাঁট্টা খেতে হয়েছিল চাম্পুকে । সেই দিনকার চাম্পুর লাঞ্ছিত মুখখানা আজও আমার মনে পড়ে । বেচারা ঠিক করে কাঁদতেও পারছিল না, খালি গোঙাচ্ছিল । আর তাছাড়া চাম্পুর উপস্থিতিতে টুকলি করার দুঃসাধ্য কেউ দেখায় না । সবার চোখে ফাঁকি দেওয়া যায় কিন্তু চাম্পুর আঁখিতে ফাঁকি দেওয়া প্রায় অসম্ভব । ব্যাচে পরিক্ষার সময় চাম্পুর কোতোয়ালগিরির জবাব নেই ।
আসলে সব কিছুতেই ওর নাক গলানো চাই । সেবারের পরীক্ষাতে পচাকে যেভাবে ধরিয়ে দিল তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য । টুকলির কি দুর্দান্ত এক কৌশল অবলম্বন করেছিল পচা । সব কটা প্রশ্নের উত্তর নিখুঁতভাবে নামিয়ে দিয়েছিল । আমরা কেউ টের পায়নি, স্যার পর্যন্ত না । কিন্তু চাম্পুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি পচা । চাম্পু নিজে একটাও প্রশ্নের উত্তর ঠিকভাবে কমপ্লিট করে না কিন্তু অন্যেরা কি করছে না করছে, তা ওকে দেখতেই হবে ।
তবে পচার টুকলি করার কৌশলটা একটু বলা দরকার । আসলে পচা সবকটা প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই নকল করে এনেছিল । কাজেই যে যে প্রশ্নগুলো স্যার সাজেশান করে দিয়েছিলেন সেই সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো অদ্ভুত কায়দায় সবার চোখের আঁড়ালে পিচবোর্ডে পর পর সাজিয়ে নিয়েছিল । আর তারপর সেই উত্তরগুলোর উপর মিছিমিছি পেন বোলাতে লাগল । আমরা ভেবেছিলাম পচা দিব্যি লিখে যাচ্ছে । আমাদের যখন ভেবে ভেবে লিখতে হচ্ছিল তখন পচার কলম টগবগিয়ে দৌড়চ্ছিল । আমি ভেবেছিলাম পচা নিশ্চয় জোরদার প্রিপারেশন করে এসেছে । কিন্তু কে জানত যে এর পিছনে পচার ছলচাতুরী আর কারচুপির কার্যকলাপ রয়েছে । কেবলমাত্র চাম্পুই জানতে পেরেছিল । চাম্পুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জেরেই এই রহস্যের জট খুলে গেছিল সেদিন ।
সেদিন পচাকে ভয়ঙ্কর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল মানে সেই রামগাট্টা হজম করতে হয়েছিল তাও আবার একটা নয় গুণে গুণে গোটা পাঁচখানা রামগাট্টা আর সুদ হিসেবে কানমোলা । তারপর দুদিন ব্যাচে পড়তে আসেনি পচা । বাড়িতে মা বাবাকে বলতেও পারে নি বেচারা । অসহায়তার করুণ পরিণতি এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে ।
যাক্ গে, স্যারের কুখ্যাত রামগাট্টা খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই তাই টুকলি করার পরিকল্পনাকে ভুলাঞ্জলি দেওয়াই সঙ্গত বলে মনে হল । আবার কম নম্বর পেলেও চাম্পুর টিঁটকিরি সহ্য করতে হবে । নিজে ব্যাটা ফেল করবে, গোল্লা পাবে সেটা দেখবে না । লোকের ফলাফল দেখার খুব উৎসাহ মহাশয়ের, মানে মহা শয়তানের ।
সুতরাং সমস্ত দিক থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর ঠিক করলাম, যতক্ষণ না এই তিনখানা উপপাদ্য উদ্ধার করতে পারছি ততক্ষণ খাতা কলম ছেড়ে উঠছি না । আমার প্র্যাক্টিসটা যখন চরম পর্যায়ে ঠিক এমন সময় মায়ের আদেশ এল, প্যাঙার দোকান থেকে এক প্যাকেট মুড়ি কিনে আনতে হবে । মুড়ির দাম আমার হাতে দিয়ে মা বলল, "শিগগির্ যা ! "
আমি শীঘ্রই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জলদি জলদি হাঁটতে লাগলাম । দোকান ফাঁকাই ছিল তাই যাওয়া মাত্র মুড়ির প্যাকেট কিনে যতটা দ্রুত গিয়েছিলাম ততটাই দ্রুত বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম । ফেরার পথে হঠাৎ পচাদের গলিটার কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম । চেয়ে দেখি, গলির অন্ধকারমতো জায়গাটাই একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে । আচমকায় কালো মূর্তিটাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম । কেন জানি না আমি কয়েক সেকেন্ড স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । পা দুটো কোনোমতেই এগোতে চাইল না । মূর্তিটা যখন আমার দিকে এগিয়ে এল তখন জ্যোৎস্নার আলোয় পরিস্কার দেখলাম, এ ওইসব নয় যেসব ভেবে আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছিলাম । এ হল আমাদের চাম্পু ! কিন্তু রাত্রি বেলায় চাম্পু একা একা এখানে কি করছে !
হাতদুটোকে পিছনদিকে বাঁকিয়ে মাথা উঁচিয়ে পুরো জমিদারী মেজাজে আমার কাছে এসে দাঁড়াল । তারপর আমার খবর নিল । হেঁড়ে গলায় বলল, "কি রে কাল পরীক্ষা আছে আর ঘরে বসে পড়াশোনা করা বাদ দিয়ে তুই ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস ?"
ঠিক এই প্রশ্নটাই আমার ওকে করা উচিত । রাত ৮টা কি সাড়ে ৮টা বাজে । আর এই রাতের বেলায় পচাদের পাঁদারে একা একা কি করছে ও ? কাল ওরো তো পরীক্ষা আছে ?
আমি বললাম, " তোরও তো পরীক্ষা আছে তবে তুই কেন ঢিলো খেলে বেড়াচ্ছিস ?" চাম্পু বলল, "আমার ব্যাপারে তোকে অত চিন্তা করতে হবে না ।"
আমি বললাম, "তবে তোকেও আমার চিন্তা করতে হবে না !"
চাম্পুর মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর ওর সাথে আর বকবক না করে আমি বাসায় ফিরলাম । আবার বই-খাতা-পেন নিয়ে কসরত করতে লাগলাম । সকাল সকাল উঠে আরোও দুবার প্র্যাক্টিস করে নিলেই গ্যারান্টি উতড়ে যাবে । বেশি রাত না করে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের মোবাইলটায় অ্যালার্ম দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম ।
দিব্যি এক্কেবারে ভোরবেলায় ঘুমটা ভেঙে গেল তবে অ্যালার্মের টিক্ টিক্ শব্দে নয়, অন্য একটা শব্দে । শব্দটা আসছিল পচাদের গলিটা থেকে ।
পচার মা চেঁচাচ্ছে । অসভ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে । আসলে ভোর বেলায় প্রায় আমাদের পাড়াতে টাইমকলে জল তোলা নিয়ে ঝগড়া হয় ।
সকাল ছটায় কলে জল আসে আর সেই জলভরা নিয়ে মাঝেমধ্যেই পাড়ার মাসিরা পিসিরা তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হন । হাতাহাতি মারামারি এমনকি কাটাকাটি ফাটাফাটি পর্যন্ত হয়ে যায় ।
বাবা বিরক্তিস্বরে বলল, "এই পচার মা টা সত্যি বাবা ! জিনিস্ একখানা । জান্ জ্বালিয়ে খেলে !
মা মর্নিংওয়াক থেকে এই সবেমাত্র ফিরেছে । ফিরে এসে বলল, "শ্যামলদার বাড়ির সদর দরজায় কে হাতের ছাপ মেরেছে ? ঐ নিয়েই পচার মা চেঁচাচ্ছে । "
শ্যামল হালদার মানে পচার বাবা নাকি রাগে গজগজ করছে । বাড়ির সামনে কেউ নোংরা করলে যার মাথায় আগুন উঠে যায় আর তার কিনা নক্সা করা কাঠের দরজায় হাতের ছাপ মারা হয়েছে । এতো বড়ো দুঃসাহস কার হল । এই কাজ যে করেছে তার পিন্ডি চটকে দেবেন শ্যামলবাবু । অবশ্য অপরাধি ধরা পড়লে তবেই ।
পচাদের সদর দরজার অপূর্ব সৌন্দর্য্য নষ্ট করল কে ? একবার পচাদের বাড়ি গিয়ে দেখা দরকার । জামাটা গায়ে দিয়ে সোজা পৌঁছে গেলাম পচাদের গলিতে । গলির মুখেই বাঁদিকে পচাদের বাড়ি । দরজার কাছে পচার মা দাঁড়িয়েছিল তাই কে কিধরনের ছাপ মেরে দিয়ে গেছে তা দেখতে পেলাম না । গলিতে পচা দাঁড়িয়ে আছে । টোটনের মা, সম্পার মা, আর পচার মা ফিসফিস করে কিসব বলাবলি করছে ।
পচার কাছে গিয়ে বললাম, "কি হয়েছে রে পচা ?
পচা মুখে কোনোরকম শব্দ না করে ওদের দরজাটার দিকে আঙুল দেখাল । দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম দরজার উপরের দিকটাই একটা কালো রঙের হাতের ছাপ । কেউ আলকাতরা হাতে মেখে পচাদের সুন্দর কাঠের দরজায় গোপনে বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছে । সামনেই ভোট কিনা ? কিন্তু কালো হাতের বিস্ফারিত পাঞ্জা কোন রাজনৈতিক দলের প্রতীক চিহ্ন কে জানে ?
- 'এই চিহ্নে ভোট দিন'- এটা লেখাটা নেই কেন ?
- নাকি কেউ মজাক মাস্কারা করেছে ?
পচার মা কিসব বলাবলি করছে দুজন প্রতিবেশীর সাথে । সবকটা কথা না বুঝতে পারলেও একটা শব্দ কাঁটার মতো আমার কানে বিঁধল । আর সেই শব্দটা হল 'কালাজাদু' । কিন্তু কেই বা কালাজাদু অথবা জাদুটোনা করতে যাবে পচাদের ওপর । করতেও পারে, পচার মা যা ডেঞ্জারেস্ ! নিশ্চয় কারো পাকা খইয়ে মই দিয়েছে !
যাক এসব ভেবে আমার কোনো লাভ নেই । বরং নিজের পড়াটা করি গে ! তাই আবার বাড়ি ফিরে এসে ব্রাশট্রাশ করে নিয়ে পড়তে বসলাম ।
টিউশনে গিয়ে দেখি প্রায় সবাই এসে গেছে। পচাও এসেছে তবে চাম্পুকে দেখছি না যে। ব্যাটার ছেলে আজ পরিক্ষা দেবে তো ? দিতেই হবে, না দিলে যে স্যারের রামগাট্টা ! সেটা কি তার মনে নেই ? দিব্যি মনে আছে !
কাগজ পেন সব রেডি করছি ঠিক তখনই চাম্পুর আগমন। আসা মাত্র পচার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, কিরে পচা সব পারবি তো ? আগের মতো টুকলি করে নিয়ে আনিসনি তো আবার ? - এই বলে চাম্পু পচার পিচবোর্ডখানা ভালো করে মানে একেবারে খুঁটিনাটি করে দেখে নিলে।
পচা টুকলি করে নি। কিন্তু তবুও ওর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে পারা হয়ে আছে। সাতসকালে যেমনটি দেখেছিলাম ঠিক সেরকমই। বোধহয় ঐ কালাজাদুর ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ রকম চিন্তিত।
চাম্পুকে বললুম, পচাদের ব্যাপারটা শুনেছিস্।
চাম্পু বলল, কি ব্যাপার !
বললুম, ওদের দরজায় কে যেন কালো হাতের ছাপ মেরেছে, শুনিসনিস্ ? গোটা পাড়ায় হৈচৈ মেতে গেল আর তোর কানে খবরটা যায়নি, বলিস্ কিরে ?
চাম্পু সটান পচার দিকে ফিরে বলল, 'কি হয়েছে রে পচা ?'
পচা বলল, কে আমাদের বাড়িতে জাদুটোনা করেছে !
চাম্পু বলল, "এই রে...! কালা জাদু ! সে তো ভয়ঙ্কর জিনিস ! গতবছর ওপাড়ার টুকুর উপরও নাকি কালাজাদু করেছিল। একদিন রাতে ওকে আর পাওয়া গেল না। সবাই মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত পরিমলের গাবাতে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। তারপর অনেক সরষেপড়া, তেলপড়া, তাবীজ টাবীজ দিয়ে দোষ কাটানো হয়েছিল। দেখিস নি নাকি ? ঐ তো জিৎও দেখছিল। "
জিতের দিকে তাকালাম। জিৎ মাথা নেড়ে চাম্পুর কথায় সায় দিল। চাম্পু হঠাৎ পচার গায়ে হাত রেখে বলল, "ভাই সাবধানে থাকিস যেন ।"
দেখলাম, পচার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পচা যে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।
এদিকে স্যার এসে উপস্থিত। কোয়েশ্চেন দিয়ে নেকোসুরে বললেন, সময় মাত্র দেড় ঘণ্টা । মনে থাকে যেন। কেউ কারোর দেখবি না। নে শুরু করে দে উল্লুকের দল।
যে যার খাতা পেন নিয়ে শুরু করে দিলে। সবাই নিজ নিজ খাতা ভর্তি করতে ব্যস্ত। আমিও একটার পর একটা অঙ্ক কষতে লাগলাম। দুইখানা ঊপপাদ্য কমন পেয়েছি। একেবারে হুবহু দুটোই ছাপিয়ে দিলাম। এক দুটো অঙ্কের উত্তর মেলাতে পারলাম না বটে, তবে যতটা ঠিক ঠাক হয়েছে সেখান পর্যন্তই করে ছেড়ে দিলাম। উত্তর না মেলাতে পারলেই বা !যতটা ঠিক করেছি তার নাম্বার তো পাবো।
মাঝে একবার পচার দিকে তাকালাম। বেচারার মুখটা এখনো শুকিয়ে আছে। ঐ শুকনো মুখ নিয়েই অঙ্ক কষে যাচ্ছে। ওকে দেখে বড়ো মায়া হল।
দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। সবাই খাতা জমা দিয়ে দিলাম। চাম্পুটা কি করেছে কে জানে ! বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় চলতে চলতে দেখলাম চাম্পু পচার কানে বিড়বিড় করে কি সব বলাবলি করছে আর পচাটা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।
কি বলছে চাম্পু ওকে ? বোধহয় সহানুভূতি দিচ্ছে ? বাঃ চাম্পুটা বেশ ভদ্র হয়েছে দেখছি।
দুপুর বেলায় খেয়ে দেয়ে মসজিদের গলিটাতে যেই একটু দাড়িয়েছি অমনি দেখি পচা আর চাম্পু আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি তখনই জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছিস রে তোরা ?
দুজনেই একসাথে আমার দিকে তাকালো কিন্তু কোনো সাড়া দিল না। এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল যেন আমাকে চেনেই না।
ব্যাপার কি ? আশ্চর্য ! খুব অবাক করা বিষয় !
না ! ব্যাপারটা একটু দেখা দরকার।
সুতরাং স্থির করলাম বিষয়টিকে যাচাই করে দেখব। তাই চুপি চুপি ওদের পিছু নিলাম।
তেলিয়াপুকুরের ওপারে বটতলায় দুজনাকেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতে দেখলাম। আমিও কিছুটা দূরে একটা নিমগাছের আড়ালে ওদের লক্ষ্য করতে লাগলাম।
আধঘন্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেল। ওরা এখনও গাছ তলাতেই রয়েছে।
হঠাৎ কালো লম্বামতো ঢ্যাঙা টাইপের একটা লোক কখন যে বটতলায় উদয় হল টেরই পেলুম না।
মাথায় লাল রঙের কাপড়ে ফাট্টি বাঁধা, পায়ে জুতো টুতো কিচ্ছু নাই মানে খালি পা, গায়ে একটা হলদে রঙের হাফহাতা কুর্তা এবং বেগুনি রঙের ছাপা লুঙ্গি, আর কাঁধে ঝুলছে একখানা বোঁচকা ঝোলা।
আরে এ তো সেই সাপুড়েটা ! কাল পগাড়পাড়ে সাপ খেলা দেখাচ্ছিল। তারপর মাদুলী টাদুলী কিসব যেন বেচ্ছিল। এ তো ওঝা, ব্যাটা ফোঁস ফোঁস করে বিড়ি টানছে।
চাম্পু পচা আর ওঝা তিনজনা মিলে বটতলায় বসে গোলটেবিল বৈঠক করতে লাগল। কিসব বলাবলি চলছে তার কিছুই শুনতেও পেলাম না আর বুঝতেও পারলাম না। মিনিট সাতেক কি দশেক বৈঠক চলল। তারপর তিনজনায় একসাথে উঠে দাঁড়াল এবং হন হন করে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল।
প্রথম টাই একটু ঘাবড়ে গেছিলাম, দেখে ফেলেনি তো আবার। আমি সড়াৎ করে ওখান থেকে সরে পড়লাম। কিন্তু আড়ালে আবডালে ওদের পিছু নিলাম। ওরা আমাদের পাড়ার দিকেই যাচ্ছে।
এবার আমি পুরো ব্যাপার টা বুঝতে পারলাম। ওঝা দিয়ে বোঝা সড়ানো হবে অর্থাৎ বাড়ির দোষ কাটানো হবে। তা বাপু আমাকে সাথে নিলেও নিতে পারতো। আমি তো পচাদের ভালোই চাই। আমাকে জানালে কোন মহাভারত টা অশুদ্ধ হয়ে যেত শুনি। যতসব দেখতে পারো।
তবে মনের ভিতর খটকা হতে লাগল। নিশ্চয়ই কিছু ব্যাপার আছে যা চাম্পু কাওকে বলতে চাইছে না, আমাকেও না। কিন্তু কি ব্যাপার হতে পারে ?
এতে চাম্পুর কোনো চালাকি টালাকি বা কোন ফন্দিফিকির অথবা কোন অভিসন্ধি লুকিয়ে নেই তো ? কারন চাম্পু কে চিনতে আমার বাকি নেই। তাই কিছু থাকলেও থাকতে পারে। নাঃ, এটার শেষ দেখেই ছাড়বো।
সোজা চলে এলুম পচাদের গলিতে। পচাদের বাড়ির পিছনের দিককার প্রাচীরটা অনেক পুরনো, জরাজীর্ণ অবস্থা। একটা কোণ তো বলতে গেলে ধসেই গেছে। শ্যামলকাকু ভীষণ চালাক। বাড়ির সামনে টা রঙটঙ করিয়ে একদম চকচকে বানিয়েছেন, আর পিছনটা তো দেখার লোক নাই তাই ওদিকটাই হাতই লাগাননি। ব্যবসাদার মানুষ বলে কথা !
ধসে পড়া কোণটার কাছেই একটি ফুলের গাছ পুরো ঝোপ মতো হয়ে রয়েছে। এখান থেকে বাড়ির বাগানটা পুরো দেখা যায়। আর ওদিক থেকে কেউ সহজেই আমাকে দেখতে পাবে না, সুতরাং এখানেই আশ্রয় নেওয়া যাক।
ওরা এখনও বাড়ির ভিতরে তাই কি চলছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না । চাম্পু ওদের ঘরেই রয়েছে ব্যাটা। তুকতাক ঝাড়ফুক কি তবে শুরু হয়ে গেল নাকি?
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। মিনিট খানেকের মধ্যে পচার মা, বাবা, পচা, চাম্পু এবং ওঝা সকলেই বাগানের ফাঁকা মতো জায়গায় উপস্থিত হল। অনেকক্ষণ ধরে কিসব হিজিবিজি কথাবার্তা চলল, কিছু কিছু বুঝলুম আর বাকি সবটুকু না বুঝে অবুঝের মতো ফ্যালফ্যাল করে এই বিচিত্রানুষ্ঠান হজম করতে লাগলুম।
কোথা থেকে ইট এনে মাটি লেপে কাঠকুড়ো দিয়ে একখানা আস্ত যজ্ঞাগ্নিকূন্ড বানানো হলো। তারপর ওঝা বসলেন কূন্ডের পশ্চিমে পূর্ব দিকে মুখ করে। আর চাম্পু বসল ঠিক ওঝার পিছনে, যেন চাম্পু ওঝার এ্যসিস্টেন্ট। পচার মা আর পচার বাবা দুজনা কূন্ডের দুইদিকে একে অপরের দিকে মুখ করে বসেছেন। আর পচা বসেছে ওঝার দিকে মুখ করে।এবার বোধহয় যজ্ঞ টা শুরু হল বলে। বেশ মজা হবে, জীবনে কখনও এই জিনিস দেখিনি। এবার স্বচক্ষে দেখবো, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। একটা অভিজ্ঞতা তো হবে বটে।
চাম্পুর এই অভিজ্ঞতা আগে থেকেই আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাপারে চাম্পু কোনোদিন আমাকে বা আমাদের কারোকে বলেনি। না বলারই কথা, চাম্পুকে আবার চিনি নে ! ব্যাটা ন্যাকামি আর ঢ্যাঁটামির যম একখানা। লোকের পেটের কথা ঠিক বের করে নেবে কিন্তু নিজে একটাও উগলোবে না।
মন্ত্র পাঠ তন্ত্র পাঠ শুরু হল। মহা তন্ত্রিকের যান্ত্রিক ক্রিয়া কলাপ বোঝার সাধ্যি ইহ কালের কারো আছে বলে সন্দেহ। বিড়বিড় করে আজব ভাষায় কিসব বলে চলল তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। কোন দেশের ভাষা কে জানে ! তবে ওঝা নিশ্চিত বাঙাল। কথা শুনেছি সাপখেলা দেখানোর সময়। ঘন্টা দেড়েক চলল ভন্ডের ভন্ডামি। পচা, পচার মা আর পচার বাবা একদম চুপ। চাম্পুও চুপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তবে চাম্পু কে কয়েকবার আঙুল মটকাতে দেখলাম। মনে হচ্ছে যত টেনশন চাম্পুরই।
হঠাৎ করেই ওঝার যাগযজ্ঞ শেষ হল। কিছক্ষণের জন্য পরিবেশ একেবারে শান্ত ! কোনো শব্দ নাই, পাখিদের কিচিরমিচির নাই। কাকের কা..কাও নেই। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দও, গাছের পাতাও নড়ল না। গোটা বিশ্বটা যেন নিশ্চল হয়ে গেল।
তারপর আচমকা শুনলাম ওঝার বিকট হাসি। হো হো করে ওঝা হেসে উঠল। চিৎকার করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, যাবে না মানে ! বাপ্ বাপ্ বলে যাবে !
যেতেই হবে ! সব ব্যাটাদের তাড়িয়েছি। আমার হাত থেকে কেউ নিস্তার পাইনা। সবগুলোকে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়েছি। আর আসবে না। কোনো দিন আসবে না। নিঃস্ব করে দিয়েছি এক্কেবারে।
- এই বলে আবার হো হো করে বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল।
পচার মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর বললেন,
"বাব্বা! গাখানা একেবারে হালকা হয়ে গেল, যা ভারী হয়েছিল না তা আর বলা যায় না। বাঁচালেন বাবা, আপনিই আমাদের বাঁচালেন। "
ওঝা বললেন, "আর কোন চিন্তা নেই।"
বলেই উঠে পরলেন। তারপর আবার বললেন, "এবার আমায় যেতে হবে। অনেক কাজ বাকি রয়েছে। "
"তা আপনার দক্ষিণা টা !", বলেই শ্যামলকাকু চুপ করে গেলেন। যেন কথাটা বলতে ওনার খুবই কষ্ট হচ্ছিল।
ওঝা বললেন, "মানুষের জীবনে সুখ শান্তি ফিরিয়ে দেওয়ায় আমার কাজ। পরের মঙ্গলেই আমার মঙ্গল। তবে দক্ষিণার কথা যখন বললে তবে বলে রাখি কত লোকের যে ভালো করেছি তার নাই ঠিক ! খুশি করে কতজন হাজার পাচেক দশেক টাকাও দিয়েছে, নিতে চাই নি তবু জোর করে দিয়েছে। আমি সাধু মানুষ, টাকা নিয়ে কোথায় যাবো বলো। তবে দক্ষিণা যদি দিতেই চাও, তবে একুশশো এক টাকা দাও। না কম না বেশি, নতুবা একটি টাকাও দিওনা। " এই বলে ওঝা গম্ভীর মুখে করে দাড়িয়ে রইলেন।
পচার মা বলল, "তা কি করে হয়। আপনি আমাদের এত বড়ো একটা উপকার করলেন, দক্ষিণা তো আপনাকে নিতেই হবে।"
এক মিনিটের ভিতরেই পচার বাবা ঘরে ঢুকে আবার ফিরে এলেন। তারপর গুণে গুণে একুশশো এক টাকা ওঝার হাতে দিলেন। আর ওঝা টাকা ঝোলায় রেখে আশীর্বাদ করে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিছক্ষণ পর চাম্পুও সড়াৎ করে বেরিয়ে গেল। কেন জানি না মনে হল একবার চাম্পুর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলা দরকার। তাই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলুম আর চাম্পু যেদিকে গেল সেদিকেই হাঁটা দিলাম। মেডিকেল কলেজের মাঠটা পেরিয়ে দেখলাম চাম্পু আরও জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো। আমিও স্পীড বাড়ালাম।
সন্ধ্যা প্রায়ই হয়ে এল বলে। দিনের আলো এখনও সবটুকু যাইনি। একে অপরের থেকে খানিকটা তফাৎ বজায় রেখে আমরা একই দিকে চলতে লাগলাম।
এভাবে চলতে চলতে তেলিয়াপুকুরের কাছে চলে এলাম। চাম্পু পুকুর পেরিয়ে ওপারে বটতলাতে পৌঁছে গেল। কাছেই বিশাল মোটা ইউক্যালিপটাস গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম।
দেখলাম চাম্পু দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছে ও ?
কেউ একজন তো আছেই বটগাছের আড়ালে ?
স্পষ্ট শুনলুম চাম্পু বলল, কেমন ভেলকি দেখালাম বলুন !
-ভেলকি ? কিসের ভেলকি ? কাকে ভেলকি দেখালো চাম্পু ?
হঠাৎ একটা বিকট হাসি শুনলাম। আড়ালে থাকা সেই ব্যক্তি হো হো করে হেসে উঠল। এই হাসিটা আমার চেনা। এই হাসিটা শুনেছি পচাদের বাড়িতে। তার মানে ঐ ব্যক্তি সেই ওঝা।
আড়াল থেকে এবার ওঝা সামনে এল। চাম্পু আর ওঝা দুজনায় হো হো হি হি করে কিছক্ষণ হাসতেই থাকল। ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকি রইল না।
ব্যাটা চাম্পুর ভেলকিবাজী এখন স্পষ্ট আমার কাছে। তার মানে পচাদের দরজায় কালো হাতের ছাপ দিয়েছিল চাম্পুই। আর সেটা কাল রাত্রে আটটা কি সাড়ে আটটার নাগাদ যখন আমি মুড়ি কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। আর এই ভেলকিবাজী চাম্পুকে শিখিয়েছে ঐ ব্যাটা পাজী ওঝা। খদ্দের হিসেবে পচাদের খোঁজ চাম্পুই ওঝাকে দিয়েছে। তারপর দুই জনা মিলে এই কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছে।
চাম্পু এতটাই চালাক হতে পারে ভাবতে পারিনি। এই বুদ্ধিটা কি ওঝার নাকি চাম্পুর। চাম্পুর হলেও অবাক হবো না। দিন দিন ওর চালাকির মানদণ্ড বেড়েই চলেছে। বয়স তো বাড়ছে তবে কূটবুদ্ধিটাই বা বাড়বেনা কেন ?
শুনলাম চাম্পু বলল, "তাহলে কাকা এবার আমার কমিশনটা ছাড়ো। একটু মালকড়ি আমার পকেটে চালান দাও দেখি। "
"নিশ্চয় ! নিশ্চয় !" এই বলে ওঝা তার ঝোলাতে হাত ঢুকালো । তার পর একটা গোখরো বের করে চাম্পুর দিকে সটান বাড়িয়ে দিল। অমনি চাম্পু ধড়াস্ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে আমার বুকটা ধড়াক্ ধড়াক্ করতে শুরু করে দিল।
"ওরে বাবা ! ওরে বাবা রে !"- বলতে বলতে চাম্পু দৌড় মারলো। দৌড়তে দৌড়তে দুবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। তবু একটুও দমল না, উঠে পড়ে আবার দৌড় ! কাওকে এত জোরে দৌড়তে আমি দেখিনি।
ওঝা হো হো করে বিকটভাবে হাসতে হাসতে বলল,
কেমন ভেল্কি দেখালাম বল্ ।।
Written By- Aalim Babu
Tags
# কিশোর সাহিত্য

About বাংলা গল্পসল্প
Templatesyard is a blogger resources site is a provider of high quality blogger template with premium looking layout and robust design. The main mission of templatesyard is to provide the best quality blogger templates.
Related Posts:
কিশোর সাহিত্য
Labels: photos
কিশোর সাহিত্য
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment