"বামপালের কৃতিত্ব"
"আলীম বাবু"
আজ হরপ্রসাদ পালের কলেজে প্রথম দিন। "বর্ধমান রাজ কলেজ" বর্ধমানের অন্যতম সেরা কলেজ। হরপ্রসাদ ওরফে হরি এই কলেজের ইতিহাস অনার্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সুতরাং ক্লাসে বসে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে সাবাসী দিতে সে এতটুকুও কুণ্ঠা বোধ করল না। অনার্স করছে বলে কথা তাও আবার ইতিহাসে।
ইতিহাসের নাম শুনে কত জবর জবর ছেলেদের পিলে চমকাতে দেখেছে হরপ্রসাদ। "ইতিহাসে পাতিহাঁস" কথাটা কেই বা না শুনেছে, বলতে গেলে সবাই শুনেছে।
কিন্তু হরপ্রসাদের ক্ষেত্রে শুধু শুনেছে বললে বোধহয় ভুল বলা হবে, মেনেওছে বটে। কারন আগের শ্রেণীগুলোতে ইতিহাসের নম্বর সেদিকেই দৃষ্টিপাত করে। মাধ্যমিকে ইতিহাস আর গণিত ছাড়া বাকি সাবজেক্টগুলোয় মোটামুটি ভালোই নাম্বার করেছিল এবং ফাষ্ট ডিভিশনটাও হাসিল করে নেয়। তারপর আর্টস্ নিয়ে লড়াই শুরু । প্রথম প্রথম ইতিহাস সাবজেক্টটা নিতেই চাইছিল না।
কিন্তু প্রাইভেট টিউটর অমলবাবু যখন বললেন, "দর্শনটা তোর পক্ষে বোধহয় একটু কঠিন হবে বুঝলি, আবার সংস্কৃতটা আরো জোরালো। আগে ঠিক ছিল, এখন নাকি আবার প্রশ্নের উত্তরগুলো সব দেবনগরী ভাষায় লিখতে হয়, সে একরকম মহা ঝামেলা।"
এটা শুনে হরির চক্ষু যেন চরকগাছ হয়ে গেল। সংস্কৃত পড়তে গিয়ে যার চোখ উলটে যায় সে নাকি সংস্কৃতে লিখবে। ক্লাস এইটের সংস্কৃত পরিক্ষাটা কিভাবে উতরেছে তার বর্ণনা করতে গেলে বোধহয় রামায়ণের লঙ্কাকান্ডও ফেল হয়ে যাবে। পরিক্ষা দিতে দিতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে উবে গেছিল সেই পরিক্ষা দিন । সুতরাং সংস্কৃতের কথা একদম আসবেই না। ওটা বাদ।
স্যার বললেন, "ইতিহাস টা নে বুঝলি হরি। এটা মোটামুটি চলে যাবে। সেই একই ঘেঁষাপেটা জিনিস। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আর আধুনিক যুগ। আর কিস্সু নাই। একেবারে জলের মতো সহজ। আমিই পড়িয়ে দেবো। "
যতটা সহজ করে স্যার বললেন ততটা সহজে হরি বিষয়টাকে নিতে পারলো কি ? শেষমেষ ইতিহাসটাও মেন সাবজেক্টের মধ্যেই রাখা হল। বাকি দুটো হল ভূগোল আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। স্যারের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানটা নাকি ইতিহাসেরই ভাইরাভাই। এদিকে কম্পালসারিতে বাঙলা আর ইংরেজি তো রয়েছেই।
একাদশ শ্রেণির পুরো সেশনটায় ফাঁকি দিতে কোথাও কোনো ফাঁক রাখেননি মিঃ হরপ্রসাদ পাল। প্রায় ফেলই করে গেছিল বললে চলে। আটেন্ড্যান্স খাতায় বিস্তর এ্যবশেন্ট, এমনকি ভূগোল প্র্যাকটিক্যাল পরিক্ষার দিনও আ্যবশেন্ট্। এটা তো আর মগের মুলুক নয় যে পরিক্ষা না দিয়েই উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। যথারীতি গার্জেন কল করা হল। এখানেও ফাঁকিবাজি। অভিভাবক স্বরূপ হস্তাক্ষর করলেন প্রাইভেট টিউটর অমলবাবু। আলাদা ভাবে নেওয়া হলো প্রাকটিক্যাল পরিক্ষা। পাশও করিয়ে দেওয়া হল।
তবে এর ফল খুব একটা ভালো হয়নি। বড্ড বেইজ্জত হতে হয়েছিল হরিকে সেদিন । পাড়ার লোকেদের সামনেই বাবার দেওয়া উত্তমমধ্যম সহ্য করতে হয়েছিল একবারে মুখ বুজে । এবং শপথও নিতে হয়েছিল দ্বাদশ শ্রেণীতে উত্তম রেজাল্ট করতেই হবে।
আর করেও দেখিয়ে দিল হরি এক বছরের ভিতরে। এইটটি পারসেন্ট মার্কস্ নিয়ে তাক লাগিয়ে দিলো গোটা পাড়াকে। গর্বে বাবার ছাতি হল ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। থার্ডকেলাস ছেলের ফার্ষ্টকেলাস রেজাল্ট করাটা পাড়াপোড়োশির চোখমুখ বাঁকিয়ে দিয়েছিল সেদিন ।
হরির নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু মার্কশিটই বলল শেষ কথা, বাকিটুকু ইতিহাস। ইতিহাসে পঁচাশি পাওয়াটা চমৎকারের থেকে কম কিছু নয়। সবথেকে বেশি নম্বর ইতিহাসে সুতরাং বাবা এবং স্যার অমলবাবুর এক সিদ্ধান্ত, হরি হবে ইতিহাসে অনার্স গ্রাজুয়েট এবং তারপর নেবে ইতিহাসে মাষ্টারডিগ্রি। কিন্তু হরির নিজ সিদ্ধান্তে ইতি।
কলেজে প্রথমদিন একটুআকটু নার্ভাস্ তো সব নিউকামারস্ দেরই হয়ে থাকে। স্বভাবতই হরপ্রসাদের নার্ভগুলোও একটুআকটু বিচলিত হচ্ছিল বইকি । তবে ক্লাসে একই সাথে ছেলে ও মেয়ে এই ব্যাপারটা তাকে খানিকটা উত্তেজিত করল বটে। কয়েকদিনের মধ্যে হরির অনেক বন্ধু জুটে গেল। আর দুই তিনখানা বান্ধবীও জুটিয়ে ফেলল মাত্র এক মাসের ভিতরেই । তাছাড়া ক্লাসের বাইরে কমনরুমে আড্ডাটাও দিনের দিন জমে ক্ষীর-পনির হয়ে গেল।
হরির পড়াশোনাতে আবার সেই ফাঁকি। দেখতে দেখতে প্রথম বর্ষের পরিক্ষার নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হল। হাতে মাত্র তেত্রিশ দিন। সিলেবাসটা মোটামুটি শেষ করে ফেলেছে কিন্তু একেবারে গিলে ফেলতে হবে যে। আর তা নাহলে ফার্ষ্টইয়ারে ফার্ষ্টকেলাসটা মিস্ হয়ে যাবে না ! আর ফাঁকি নয়, এখন শুধু পড়া আর লেখা প্রাকটিস্ ।
এই কদিনে হরি প্রচুর পড়েছে। গোঁফদাঁড়ি এক দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত বেড়ে গেছে। পাঁচ সাতটা দাঁড়ি তো পেকে একেবারে সাদা হয়ে গেছে। মোটকথা যাকে বলে কমপ্লিট্ প্রিপারেশন।
আজ তার পরিক্ষার দিন। ফার্স্ট পেপার। সকল ক্যান্ডিডেট স্কেল-পেন-পেনসিল সব নিয়ে প্রস্তুত। এক্সামিনার এসে প্রশ্নপত্র দিয়ে দিলেন আর বললেন ঘন্টা বাজলেই লেখা শুরু করে দিতে, তবে তার আগে নয়।
বারোটা বাজা মাত্র একটা ঘন্টা বেজে উঠল, ঢং...! সবার হাত চলতে শুরু করে দিল। হরপ্রসাদ সুন্দর করে একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করে দিল। তিন ঘণ্টা পনেরো মিনিটের পরিক্ষা। ধীরে ধীরে সময় এগিয়ে চলল। হরপ্পা সভ্যতা থেকে শুরু করে মৌর্যযুগ এবং গুপ্তযুগটা অনায়াসে কেটে গেল। দুই নম্বর, পাঁচ নম্বর এমনকি দশ নম্বরেরও তিনখানা উত্তর কমপ্লিট। যত ঝামেলা হল গুপ্তোত্তর যুগটিকে নিয়ে। এই জাগাটা ভীষণ টাফ। তবে হরির কাছে একেবারে যাকে বলে খাপেখাপ।
ইতিমধ্যে তিনটে ঘন্টা বেজে গেল। হাতে আর মাত্র পনেরো মিনিট। হরির এখনো বারো নাম্বারের উত্তর লিখতে বাকি। দুই নম্বরের প্রশ্নটা হল, পাল ও সেন যুগের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ রাজাদের নাম লেখ। আর দশ নাম্বারের প্রশ্নটা হল, পাল রাজা রামপালের কৃতিত্ব বিস্তারিত আলোচনা করো।
হরি দ্রুত হাত চালাতে লাগলো। হাতে মাত্র বারো কি তেরো মিনিট । হরির হাত কাঁপতে লাগলো। এতটুকু সময়ের মধ্যে পুরোটা লিখতে পারবে তো। বড় করে হেডিং দিল, "বামপালের কৃতিত্ব"। তারপর গড় গড়িয়ে চলতে থাকলো রাজা বামপালের কৃতিত্বের বিস্তৃত বিবরণ। মাত্র বারো-তেরো মিনিটে চার পাতা ছাপিয়ে দিল।
ঢং..ঢং.. ঢং..ঢং.. করে ঘন্টা বেজে উঠল। এক্সামিনার খাতা কালেক্ট করা শুরু করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে হরি পেপার গুলোকে জড়ো করে পরপর সাজিয়ে নিয়ে সুতো দিয়ে সুন্দর করে বেঁধে দিল। তারপর যেই মাত্র খাতা হ্যান্ডওভার করতে যাবে তক্ষণই চোখে পড়ল বিশাল একখানা মিসটেক্।
"রামপালের কৃতিত্ব" বলে হেডিং না করে বামপালের কৃতিত্ব লিখে ফেলছে। এই যা...! এটা যে একেবারে কাঁচা কাজ করে ফেলেছে সে। রামপালের বদলে সব জায়গায় বামপাল লিখে দিয়েছে। র-এর ফুটকুড়িটা তার অজান্তেই মিস্ হয়ে গেছে। অর্থাৎ রামপাল হয়ে গেল বামপাল।
এক্সামিনারের সামনে হরপ্রসাদ কাকুতিমিনতি করতে লাগল এই বলে যাতে তাকে মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড সময় দেওয়া হোক। এই কয়েক সেকেন্ডেই সে নিশ্চিত তার ভুলটা শুধরে নিতে পারবে । কিন্তু এক্সামিনার ছিলেন প্রচন্ড স্ট্রিক্টড্। সুতরাং হরির মিনতি পন্ড হল। অর্থাৎ খাতা ছিনিয়ে নেওয়া হল।
হরির মাথার চারিদিকে দুশ্চিন্তার অলীক অদৃশ্য ভ্রমর ভন্ ভন্ করে ঘুরতে লাগল। রামপালের জায়গায় বামপাল হওয়াতে তার পুরো নাম্বারটা যদি কাটা যায়। দশের মধ্যে ছয় গ্যারান্টি পেয়ে যেত। কিন্তু এই ভুলের কারণবশত যদি দশে শূন্য দেয় । তাহলেই গেল মানে ফার্স্ট পেপারে ফার্স্টক্লাসটা হাতছাড়া হয়ে গেল।
হরি আরও ভাবলো, যিনি খাতা দেখবেন তিনিও যদি র-এর ফুটকুড়িটা লক্ষ্যই না করেন। তাহলে তো পুরো নাম্বারটা পেয়েই যাবে।
হরি আবার ভাবলো, পর্যবেক্ষক যদি দয়ালু হন এবং বাম পক্ষের হন। আর এই ভুলটাকে যৎসামান্য ভুল ভেবে স্বয়ং নিজেই র-এর ফুটকুড়িগুলো দিয়ে দেন এবং পুরো নাম্বারটাই দিয়ে দেন। তাহলে আর চিন্তার কি।
কিন্তু পর্যবেক্ষক যদি অতি ডানপিটে হয়ে থাকেন আর 'বামপাল' লেখাটা দেখে যদি ক্ষেপে যান আর রেগেমেগে একেবারে গোল্লা দিয়ে দেন। তবে কি হবে ?
হরির বাঁ চোখের পাতা দুটো হঠাৎই ফড়ফড় করে কাঁপতে লাগলো।
Written By-

No comments:
Post a Comment