"স্মৃতিকন্যা"
মহঃ আজহার
সেদিনটা ছিল শ্রাবণ মাসের এক আর্দ্র ভেজা ভেজা আমেজ। এই আমেজে মেঘের আঁকিবুঁকি আকাশের যে প্রান্তে দাগ কাটে সেখান থেকে ঝড়ে পড়ে এক পশলা দু পশলা বৃষ্টিস্বরূপ জলরাশি। সেদিনও ঠিক সেই ভাবেই হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কুলু কুলু শব্দে অগুন্তি জলধারা নিয়তির নিয়মকে স্বাগত জানিয়ে তার গন্তব্যে ছুটে চলেছিলো। তার সকল বাঁধা ছিন্নসার , উন্মুক্ত তার পথ ।
তখন ঘড়িতে সময় বলছিল সন্ধ্যা ৬ টা বেজে ১০ মিনিট। আমি রাস্তায় ছাতাটা নিয়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লুম । প্রথমে যাবো ঔষধের দোকান তারপর বোনের টিউশন ব্যাচে। ছাতাটা না নিয়েই পড়তে চলে গেছে বোকা মেয়েটি।
কিছুটা গিয়ে চৌমাথা মোড়ে ডানদিকে তাকাতেই দেখলুম রাস্তার ওইপাশে বাবলুর চাইনিজের দোকানে কি ভীড় ! একেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা তার সঙ্গে রকম রকম চাইনিজ ডিস্ আর তারই আকর্ষণে খাদ্যরসিক বাঙালির উপচেপড়া ভীড় !
আমিও সময় নষ্ট না করে বাবলুর চাইনিজ ষ্টলে হাজির হলাম। ভাবলাম আগে কিছু অর্ডার দিই, পেটপূজো করে নিই তারপর অপূর্ণ কাজটা পূরণ করে বাসায় ফিরবো।
তারপর যথারীতি বাবলুকে দুটাে এগডেভিলের অর্ডার দিলাম। বাবলু এগডেভিলটা তৈরি করে আমার হাতে দিলে তৎক্ষণাৎ তার একটাতে কামড় দিতেই আমার নজরে এল একটি খুবই চেনা মুখ। সেই ছোটো বেলায় একসঙ্গে ইস্কুলে পড়া স্মৃতিকন্যা । এইভাবে তাকে হঠাৎ দেখে আমি বিহ্বল হয়ে পড়লাম। সেই ছোটবেলাকার মুখশ্রীতে কোন পরিবর্তন নাই, খালি কিঞ্চিৎ আকারে গড়মিল। চাঁদ কাছে এলে যেমন বড়ো দেখায় ঠিক তেমনি।
ভাবলাম স্মৃতিকন্যাও আমাকে দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে । তাই আমি ডাক দিলাম স্মৃতিকন্যাকে। ঠিক তখনই স্মৃতিকন্যা আমার দিকে তাকালো। তার দিকে এগডেভিলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
" কেমন আছিস্ রে। কতদিন পর দেখা ? নে একটা, খেয়ে দ্যাখ না ! "
তারপর সেও আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। এইভাবে দুজনার ১৫ বছর পর আলাপে নানান কথোপকথন হতে থাকে। সে অনেক গল্প। কথাবার্তা যেন থামছিলই না। দেখলাম, বাবলু আমাদের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে ।
তারপর হঠাৎ চুপ হয়ে গেলাম তার একটি মাত্র কথায় । সে বলল সে নাকি বিবাহিত আর তার একটি ফুটফুটে বাচ্চাও রয়েছে। আমিও কেমন বোকা, ওর সাথে কথা বলতে বলতে ওর সিঁথির সিঁদুরটুকুও খেয়াল করিনি।
আসলে আর যাইহোক, প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন স্মৃতিকন্যাকে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। কিন্তু বিধাতার নিয়মে যা হবার সে তো হবেই।
তারপর সেসব ভাবনা ছেড়ে দিয়ে বাবলুর বিল মিটিয়ে স্মৃতিকন্যাকে শেষ বারের মতো " ভালো থাকিস্" বলে যেই রওনা হতে যাবো এমন সময় স্মৃতিকন্যা আমায় বলে উঠল,
"সাবধানে যাস্ । ফোন করিস্। তোর মনটা খারাপ হওয়ার কারণ আমার জানা, কিন্তু আমি নিরুপায়।"
- এই বলে সেও ওখান থেকে বেরিয়ে গেল আর আমি আমার রাস্তায় চলে এলাম।
ভাবলাম জীবনের নীতিকথাটা নিজে থেকেই তৈরী হয় ঘটনা সাপেক্ষে। আমরা নিজেরা যা ভাবি সেটা কখনওই হয়না বাস্তব জীবনে ।
স্মৃতিকন্যা আমাকে ফোন করার কথা বললো না, দিব্যি শুনেছি ও বলল, "ফোন করিস্ " । কিন্তু ফোন করবো কিভাবে ? ফোন নাম্বারটাই তো নেওয়া হলো না !
আবার ফিরে গেলাম যেদিকে স্মৃতিকন্যা গিয়ে ছিল সেই দিকে। রাস্তা একেবারে জনহীন। কেউই নেই । রাস্তাটা সোজা অনেকটা চলে গেছে, আশেপাশে কোন গলি টলি কিচ্ছু নেই। মাত্র এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্মৃতিকন্যা কোথায় হারিয়ে গেল। কোন কুল কিনারা করতে পারলাম না।
ছুটে চলে এলাম বাবলুর কাছে। বাবলুকে বললাম, "হ্যাঁ রে বাবলু, ঐ মেয়েটি কোন দিকে গেল বলতো। "
"কোন মেয়েটার কথা বলছো রাজদা", বাবলু মাথা চুলকে উত্তর দিল।
"কোন মেয়েটা মানে ! এই তো কিছুক্ষণ আগে তোর দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করছিলাম। তুইও তো হাঁ করে আমাদেরকেই দেখছিলি। এর মধ্যেই ভুলে গেলি, মাথায় কি আছে শুনি। ইয়ার্কি না মেরে সত্যি সত্যি বল্ না, ওকে কোন দিকে যেতে দেখলি, আরে বাবা বল্ না।"
বাবলু হাঁ করে ঠিক ঐভাবেই আবার আমাকে দেখতে লাগলো।
বাবলু এরকম ভাবে আমাকে দেখছে কেন ? ক্ষেপে টেপে গেল নাকি ? আশ্চর্য !
আবার বললাম, কি রে বাবলু ! কি হলো তোর ! কিছু বলছিস্ না যে !
বাবলু কিছু একটা বলতে গিয়েই আবার চুপ মেরে গেল। তারপর হঠাৎই নিজে থেকেই বলে উঠল, "কিছু মনে করো না রাজদা, তোমায় একটা কথা বলছি । আমার মনে হয় তোমার কোনো ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার ।।
No comments:
Post a Comment