আজ দিনটা পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের । সকাল থেকে পুরো বিকালটা অনেক আনন্দে কেটেছে আমাদের পরিবারের সকলের । সকালে নামাজ আদায় করা থেকে সিমাই-লাচ্ছা ও পায়েশ খাওয়া, তারপর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া সবই যেন খুব আনন্দে উজার হচ্ছিল এই পবিত্র দিনটায় । কিন্তু আমি ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
আর ঠিক সন্ধ্যা হতেই আমাদের লোকালিটির মধ্যে মেলাপ্রাঙ্গনে বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মেলায় হরেকরকমের খাওয়া দাওয়া, নানান গল্পগুজব, বন্দুক দিয়ে টার্গেটের বেলুনগুলো ফাটানোর জেদ, গাগুলোনো সত্ত্বেও নাগরদোলাতে চাপার হিড়িক, এই সবই যেন আনন্দের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির অম্লান সাঁঝবেলা। এই সাঁঝবেলায় সকলেই ব্যস্ত, কিন্তু আমি ব্যস্ত হচ্ছিলাম অন্য একটা কারনে। তবে ব্যস্ততার চেয়ে উদ্বেগটাই বেশি অনুভূত হচ্ছিল।
তারপর হঠাৎই এক অতীব মনোরম কোনো গিটারের বাজনা যেন হৃদয়ের এককোণে টং.. করে বেজে উঠল। হরেক রকমের আওয়াজ যেন সুর দিয়ে নিজে নিজেই একের পর এক রাগের সঙ্গে কানের কাছে বেজে উঠতে লাগলো। এক মুগ্ধকর খুবই চেনা স্নিগ্ধ হাসি ভেসে ভেসে এসে আমার দুই কানে মৃদু ধাক্কা দিয়ে চলল।
এই তো আমার স্বপ্নের পরী দিপিকা। আমার ব্যস্ততা তথা উদ্বেগের একনিষ্ঠ কারন। দিপিকার উপস্থিতি ও তার কুহুতান আমার উদ্বেগকে এক নিমেষেই দূর করেদিল তবে উত্তেজনাটা যেন দ্বিগুণ বাড়িয়েদিল। যেমন সুন্দর তার কন্ঠস্বর, তেমনই সুন্দর তার রঙ মাখানো মুখ। তবে রঙ মাখানো ব্যাপারটা অন্য অর্থে প্রজোয্য, সেটা অন্তর্নিহিত অর্থ। আশা করি পাঠকগণ সেই উপলব্ধিটা নিশ্চয়ই করতে পারবে।
হ্যাঁ, দিপিকাই আমার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে । সেই দিপিকা যাকে দেখার জন্য পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। উন্মাদ হয়ে যাকে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়িয়েছি । সেই দিপিকা আজ আমার চোখের সামনে। এ যেন কোনো স্বপ্ন, হয়ত বা কোন মায়া তার মায়াবী মরীচিকায় আমাকে ডুবোতে চাইছে।
না, এ কোনো মায়া নয়। এ সত্যি, একেবারে ষোলআনা সত্যি। দিপিকা সত্যি সত্যি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আর হেসেই চলেছে। এই স্নিগ্ধ হাসিটা.., হ্যাঁ..হ্যাঁ.. এই হাসিটা দেখে আর শুনেই তো ওর ওপর ক্রাস্ খেয়েছিলাম। এই হাসি আমি কক্ষনই ভুলতে পারবো না, কোনোদিনও না । এই ঈদে খোদা আমায় যেন সওগাত দিয়েছেন। অতএব এই সুবর্ণ সুযোগকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। আজ ওর সাথে কথা বলবোই বলবো।
আগেরবার হাজার চেষ্টা করেও ওর সাথে কথা বলার সাহসটুকু কিছুতেই জোগাতে পারিনি । এক কদম এগিয়ে গিয়ে দুই কদম পিছিয়ে এসেছি । বন্ধুদের বহু লাঞ্ছনা সহ্য করেছি । ওরা সবাই আমার ওপর হেসেছিল সেদিন । কিন্তু আজ আর সেই সুযোগ ওদের দিচ্ছি না । ওদের আজ দেখিয়ে দেবো যে আমার ভালোবাসা কতখানি পবিত্র আর এও বুঝিয়ে দেবো যে এই ভালোবাসায় কোনা জড়তা নেই । বুঝিয়ে দেবো যে আমারও হৃদয়ের কোনো এককোণে আজও প্রেমের জোনাকি প্রেমের বাতি নিয়ে ঝিলিক্ দিয়ে বেড়ায় ।
গত বারে কথা বলার জন্য বহু হুুুড়়োহুুুড়ি করতে হয়েছিল, কিন্তু আমি ঠিক যেমনটা ভেবে দিপিকাকে মনের আঙিনায় স্নিগ্ধাসনে বসিয়েছিলাম তেমনটা সদুত্তর কিন্তু ওর কাছ থেকে পাইনি। আমি তাকে আমার প্রেমের দৃষ্টিভঙ্গিতে একান্ত সঙ্গীনী হিসেবে দেখলেও সে কিন্তু দেখেও আমায় প্রায় না দেখারই আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তবে আমার প্রকাশ্যে এতটুকুও খামতি রাখিনি দিব্যি করে বলতে পারি। এইভাবেই প্রায় আধেকটা রাত পার করে দিয়েছিলাম । কিন্তু প্রেম তার চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।
তারপর অনেক কষ্টে তার ঠিকানাটা জোগাড় করেছিলাম। হাজারবারেও বেশি বার ওর পাড়াতে রাউন্ড দিয়েছি বোধহয় । কিন্তু একটি বারের জন্যও ওর সাক্ষাৎ পায়নি। আগের বছর ঈদেই শেষ যা দেখেছিলাম। ভাগ্যক্রমে ওর নামটা জানতে পারি সেই আগের বছর ঈদেয়, কেউ একজন ওকে 'দিপিকা' বলে ডেকেছিলো । 'দিপিকা', কি সুন্দর নাম, তাই না !
'মনের মানুষের কাছে মনের কথাটা না বলতে পারলে এই জীবনটাই যেন বৃথা !'
সুতরাং একাই কয়েক পা এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । বন্ধুরা কোল্ড ড্রিংস, কোলা, ফ্রুটবিয়ার খেতে ব্যস্ত, তাই ওদের ডিসটার্ব করার কোনো ইচ্ছে আমার হল না । কারন আমার আত্মবিশ্বাসই আমায় এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, তাই পিছিয়ে যাওয়ার আর কোনো প্রশ্নই ওঠেনা ।
দিপিকার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে । দুজন ওর বয়সি আর একজন ভদ্রমহিলা যিনি প্রথম থেকেই ওর সাথে রয়েছেন, বয়স বছর চল্লিশ তো হবেই । ওনি কি দিপিকার মা ? যদিও দিপিকার মুখের সাথে তার মুখের কোনো মিল নেই । উনার গায়ের রঙ একদম কালো কিন্তু দিপিকার মুখখানা একেবারে যাকে বলে পূর্ণিমার চাঁদ । সুতরাং মা হতেই পারেন না, আত্মীয়স্থানীয় কেউ হবেন হয়ত । তার সামনে দিপিকার সাথে কথা বলি কি করে ! এক মুহুর্তের জন্যেও ভদ্রমহিলা দিপিকার সাথ ছাড়ছেন না যে ।
এ কে রে ভাই ! আগের বছর তো ছিলনা, কোথ্থেকে জুটলো এই অলুক্ষণে কে জানে ! তাহলে কি এইবারও কথা বলতে পারবো না । তাহলে কি আমার মনের কথা আমার মনের অন্তরালেই থেকে যাবে ! তাহলে কি আমার প্রেম আজ ব্যর্থ হয়ে যাবে । না, না.. এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না । একটা উপায় তো বের করতেই হবে । মনে মনে চোখ বুজে পারবারদিগারের কাছে অনুনয় করতে লাগলাম ।
তারপর উপায় হলো, কসম করে বলছি । হঠাৎই ঐ মহিলা উধাও । কোথায় গেলেন কে জানে ! তবে এটা নিশ্চিত যে খোদা' আমার বিনীত অনুরোধে বিনয়ী হয়েছেন । তাই বিলক্ষণ মনের কথাটা বলার জন্য একেবারে দিপিকার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম ।
তারপর ও আমাকে দেখতে লাগল । আমিও ওকে দেখতে লাগলাম । পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে । হঠাৎ পৃথিবীটা যেন বধির, কোথাও কোনো শব্দ নেই । আর আমিও যেন মূক । অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু একটা কথাও বলতে পারলাম না । কেউ যেন আমার কন্ঠে তালা মেরে দিয়েছে । কলের পুতুলের ন্যায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ওকে দেখতেই থাকলাম ।
দিপিকাই প্রথম কথা বলল। কিন্তু এমন একটা কথা বলল যা শুনে আমার মনে হল কেউ যেন আমাকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে, কিছুতেই শরীরটাকে স্থির রাখতে পারছিনা। যেন অলীক এক অতল খাদে পড়ে যাচ্ছি।
দিপিকা কর্কশ কন্ঠে রাগান্বিত মুখে বলল, "আমি এঙ্গেজড্ । একদম যেন আমার পিছু না করা হয়। নাহলে জনগণের গণধোলাইয়ের দ্বারা আপনাকে নাজেহাল করে ছাড়বো। "
সবই আমার পোড়া কপাল। আমার দিপিকা এইভাবে যে আমায় অবহেলা করবে, সেটা আমি কিছুতেই এক্সেপ্ট করতে পারছিনা । স্বপ্নে তো অনেক কিছুই ভেবেছিলাম । এমনকি বিয়ে থেকে শুরু করে ছেলেপিলের নাম, ঘর-সংসার সবই ঠিক করে রেখেছিলাম। নেগেটিভ পজিটিভ দুটো নিয়েই ভেবে রেখেছিলাম। নেগেটিভ দিকটাই বেশি মাথা ঘামাইনি কারন আমি এ্যক্টিভ্ অপটিমিষ্ট। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হয় আমার ক্ষেত্রেও তাই হল । আজ আমার প্রেম ব্যর্থ হল।
এইভাবে না বললেও পারতো ! আমি তো কিছুই বলিনি। ওর এভাবে রিয়েক্ট করাটা আমার কাছে যেন দুঃসহ হয়ে উঠল। ওর এই কথা শুনেই যে আমি কতটা নাজেহাল হয়েছি সে কি ও জানে !
মনে মনে ভাবলাম, ভালোবাসা দিয়ে কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। দিপিকা জানেনা আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। কলেজ শেষ করছি দুবছর হল। কত মেয়েদের সাথে আলাপ করেছি, আমার অনেক বান্ধবীও রয়েছে, তাদেরকে প্রাণখুলে হাসতেও দেখেছি। কিন্তু কই তাদের হাসি দেখে তো কোনোদিনই ক্রাস্ খাইনি, দিপিকার হাসিটাতে যেমনটা হয়েছিল ।
অথচ কত সহজেই ও আমাকে এভাবে তিরস্কার করল। যেন ওর কাছে আমি গুরুত্বহীন, আমার কোনো ভ্যালুই নেই ওর জীবনে, কিন্তু আমার জীবনে ওই সবকিছু, সেটা ও জানে না। জানলে এভাবে কথা বলতই না ।
প্রেমটাকে একটা আর্ট হিসেবেই অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ আখ্যা দিয়ে থাকেন । এটা নাকি সবার জন্য নয়। সেটাই হয়ত সঠিক তবে তাঁরা কেবল আখ্যা দিয়েই কেন হাত গুটিয়ে নেন, সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে কি তাঁদের গায়ে লাগে, নাকি এর কোনো ব্যাখ্যাই তাঁদের কাছে নেই।
প্রেম নামক আর্টটি কোথায় শেখানো হয়, কেউ জানো ? কারো জানা থাকলে দয়া করে আমাকে জানিও প্লিজ্। এই আর্ট আমাকে রপ্ত করতেই হবে। কিন্তু কার জন্য এর রপ্তানি। সে তো ঠিক করে প্রোপজ করার সুযোগটুকুও দিল না ।
তারপর ভাবলাম, দিপিকা আমাকে তাচ্ছিল্য করতেই পারে। কারন ও আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেনা । ও তো আমার ওপর ক্রাস্ খাইনি, সেটা কেবলমাত্র আমার দিক থেকেই হয়েছিল। অর্থাৎ আমার প্রেম একতরফা। ওই জ্ঞানীগুণীদের চোখে এই প্রেমের কোনও মূল্য নেই।
ভ্যালু থাকুক বা না থাকুক, মূল্য দিক বা না দিক তাতে আমার কিচ্ছু যাই আসে না। আমার ভালোবাসা আমার কাছে সবথেকে মূল্যবান। দিপিকা আমার স্বপ্নের নয়নমণি, ছিল আছে আর থাকবে চিরকাল ।
এতকিছু হয়ে যাওয়ার পর স্থির করলাম, মেলা প্রাঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। এখানে থেকে কি লাভ ! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, অন্তত আমার ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিণতিটা তো দেখে যেতে পারলাম। এটাই আমার কাছে অনেক, জ্ঞানীগুণীরা যা ইচ্ছে ভাবুক গে !
তারপর কাওকে কিছু না বলেই বেরিয়ে চলে এলাম। ভাবলাম, একটু বাইকটা নিয়ে বাইপাস হয়ে রাউন্ড দিয়ে আসি, ভালো হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। ম্যেন গেটের কাছেই বাইকটা রেখেছিলাম। চাবিটা যেই পকেট থেকে বের করেছি, অমনি চোখটা গেল ম্যেনগ্যেটটার দিকে। দেখলাম দিপিকা একাই দাঁড়িয়ে আছে গ্যেটের ঠিক ডানদিকটাই । ও আমাকেই দেখছিল কিন্তু আমি তাকাতেই মুখটা ঘুরিয়ে নিল। আর নিশ্চিত হলাম কারন আমার পিছনে এমনকি আমার আশেপাশেও কেও ছিল না।
কিন্তু ও এখানে একাই দাঁড়িয়ে আছে কেন ? কার জন্য অপেক্ষা করছে ? তাহলে কি ওর প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে ? কিন্তু কোথায় ওর প্রেমিক ? কাওকে দেখছি না যে ?
দাঁড়িয়ে দেখবো, নাকি বেরিয়ে পড়বো। একবার ওকে জিজ্ঞেস করলে হয় না ! কিন্তু আবার যদি ওভাবেই তিরস্কার করে... ।।
No comments:
Post a Comment